১৬ লাখ অবৈধ রিকশার চলাচল, নেই নিয়ন্ত্রণ
ঢাকার সড়ক ব্যাটারি রিকশার জঙ্গল

দেব দুলাল মিত্র
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:২২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপটে সড়ক এখন গতিহীন হয়ে পড়েছে। প্রায় ১৬ লাখ অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশায় অন্য সব যানবাহন ও মানুষের চলাচল এখন অনেকটাই থমকে দাঁড়িয়েছে। একসময়ের পায়েচালিত রিকশার প্রায় ৯৮ শতাংশ এখন ব্যাটারি রিকশায় পরিণত হওয়ায় সড়কে শৃঙ্খলা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। শৃঙ্খলা ফেরাতে অতীতের মতো সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কারোরই যেন কোনো দায় নেই।
জানা গেছে, ২০২৩ সালের সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ রিকশা রাজধানীর রাস্তায় চলাচল করত। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল অবৈধ, রেজিস্ট্রেশনবিহীন। ২০২৪ সাল থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। গত দুই বছরে রিকশার সংখ্যা পায় ১৬ লাখে পৌঁছেছে।
রাজধানীর আরামবাগ, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, খিলগাঁও, বাড্ডা, নয়াবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, হাজারিবাগ, কামরাঙ্গীরচর, মুগদা, বাসাবো, সায়েদাবাদ, দনিয়া, শনির আখড়াসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যাটারি রিকশার গ্যারেজগুলো থেকে প্রতিদিন শত শত রিকশা নাস্তায় নামছে। বদলে গেছে রিকশায় মডেল। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন ঢাকায় এসেই ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে সড়কে নেমে পড়ছে। এখন ভিআইপি সড়কেও অবাধে রিকশা চলছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আমরা যানজট নিরসনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সড়কে যানজট কমাতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তুলে দেয়া উচিত। কিন্তু আমরা এটা করছি না। এর কারণ হলো, তাহলে এসব চালকদের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে আমরা তাদের কোনো বিকল্প কর্মসংস্থান দিতে পারছি না। অন্য একটি বিষয় হলো আজকে নির্দেশ দেয়া হলে কাল থেকেই পুলিশ এদের রাস্তায় চলতে দেবে না। এর ফলে তারা একত্রে রাস্তায় নেমে এসে ঝামেলা করবে। এতে ঝামেলা আরো বাড়বে।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলসের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ঢাকা শহরে ১১ লাখ রিকশা চলাচল করছে। এই সংখ্যা গত সাড়ে ৩ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভেতরে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ৮ লাখ রিকশা চলাচল করছে। এর মধ্যে করপোরেশন থেকে রেজিস্ট্রেশন নেয়া ১ লাখ ৯৬ হাজার বৈধ রিকশা আছে। আরো ৪ হাজার রিকশার রেজিস্ট্রেশন দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই ৪ হাজার বৈধতা পেলে মোট ২ লাখ রিকশা বৈধ হবে। বাকি সব রিকশাই অবৈধভাবে চলাচল করছে। এই অবস্থায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আরো ২ লাখ রিকশার রেজিস্ট্রেশন দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, উত্তর সিটি এলাকায় নিবন্ধিত রিকশার সংখ্যা ৩০ হাজারের কিছু বেশি। দুই সিটি মিলিয়ে বৈধ রিকশার সংখ্যা ২ লাখ ২৮ হাজারের কিছু বেশি। তবে দুই সিটি মিলিয়ে ১০ লাখের বেশি অবৈধ রিকশা চলাচল করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একেবারেই ধারণার ওপর নির্ভর করে মোট অবৈধ রিকশার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। রিকশার ওপর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোনো নিয়ন্ত্রণ কখনোই ছিল না, এখনো নেই। দুই সিটি করপোরেশেনের এলাকায় প্রায় ১৩ লাখ রিকশা চলাচল করছে। ৫ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশাও চলছে। পায়েচালিত সব রিকশাই এখন ব্যাটারিচালিত করা হচ্ছে। পায়েচালিত রিকশার সংখ্যা রাস্তায় এখন খুবই কম। আগের সরকার-সমর্থিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ব্যাটারিচালিত ও অবৈধ রিকশা রাস্তায় নামানোর জন্য প্রধানত দায়ী। মালিক-শ্রমিকদের ব্যানারে অনিবন্ধিত সংগঠনগুলোর প্রভাবে প্রতিদিন ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশা রাস্তায় নামছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর আর ওই পরিচয় না থাকলেও প্রতিদিন নতুন করে শত শত ব্যাটারি রিকশা রাস্তায় নামছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীতে ১০ লাখের বেশি অবৈধ রিকশা চলাচল করছে। রিকশাচালক ও মালিকদের কমপক্ষে ২৮টির বেশি সংগঠন অবৈধ রিকশা নিয়ন্ত্রণ করে। এই অবৈধ রিকশা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, ঢাকা বিভাগ রিকশা ও ভ্যান মালিক সমিতি, রিকশা ও ভ্যান মালিক শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, মহানগর রিকশা মালিক লীগ, বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, জাতীয় রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ রিকশা মালিক লীগ, রিকশা শ্রমিক-মালিক লীগ, ঢাকা সিটি মুক্তিযোদ্ধা রিকশা-ভ্যান মালিক কল্যাণ সোসাইটিসহ ২৮টি সংগঠন।
এদের মধ্যে আরো আছে বাংলাদেশ রিকশা মালিক শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা রিকশা উন্নয়ন সমিতি, বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ, ঢাকা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা রিকশা-ভ্যান মালিক কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ রিকশা ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন অবৈধ রিকশার যোগানদার হিসেবে পরিচিত। প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সংগঠনের নামেও বিপুলসংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। প্রতিটি সংগঠন হাজার হাজার রিকশার নিবন্ধন করে থাকে।
নিবন্ধিত কিছু সংগঠনও অবৈধ রিকশার জমজমাট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলেও বিভিন্ন নামে এসব সংগঠনের নেতারা অবৈধভাবে রাস্তায় রিকশা নামিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব সংগঠনের নাম না থাকলেও ভিন্ন নামে নতুন নতুন সংগঠন গজিয়ে উঠছে। পুলিশ, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা এই সেক্টর এখন নিয়ন্ত্রণ করছে।
এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক দল ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা জড়িত। রাজনৈতিক দলের ইউনিট পর্যায় থেকে স্থানীয় শীর্ষ নেতারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তারাই ব্যাটারিচালিত রিকশা রাস্থায় নামাচ্ছে। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশেরও ইন্ধন রয়েছে। প্রায় দুই লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশার প্রতিটির জন্য রিকশা মালিককে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা সিন্ডিকেট বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পুলিশ যখন চাঁদার ভাগ না পায়, তখনই রিকশা আটকের অভিযান শুরু করে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, যন্ত্রচালিত রিকশার কোনো নিবন্ধন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দেয় না। ঢাকাসহ কোনো সিটি করপোরেশনও তাদের লাইসেন্স দেয় না। মূলত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পরিবহন শ্রমিক নেতা ও সমিতিও পুলিশ মিলে অর্থের বিনিময়ে এই ধরনের যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করে। রিকশা মালিকরা অভিযোগ করেন, প্রতি মাসে নিয়মিত চাঁদা দিতে হচ্ছে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের। পুলিশকেও দিতে হচ্ছে নিয়মিত।
পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবমিলিয়ে লোকজন জিম্মি হয়ে আছে অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের কাছে। প্রকাশ্যেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ গ্যারেজ ও অনুমোদনহীন ব্যাটারি চার্জার কেন্দ্র। বিদ্যুৎ চুরি হচ্ছে, রাজস্ব আয় হারাচ্ছে সরকার। ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, জনবহুল এই নগরীতে পর্যাপ্ত গণপরিবহন না থাকার কারণেই অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা বেড়েছে। রিকশার কারণে যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে, যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এখন বহু মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তাই সড়ক থেকে রিকশা তুলে দেয়া সম্ভব নয়। রিকশা চলাচলের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সবাইকে ভাবতে হবে। প্রধান সড়ক থেকে রিকশার পরিবর্তে বেশিসংখ্যক যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন যানবাহন নামানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, নগরীর সড়ক ও পরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে সুফল মিলছে না। রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া চলাচলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এতে জীবন কেড়ে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।