রাজনৈতিক তোপে আমলারা
হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩৫ পিএম
ছবি : প্রতীকী
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়সহ সারাদেশের মাঠ প্রশাসন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ‘দোসর কর্মকর্তারা’ এখনো বহাল রয়েছে। তারা কিছু উপদেষ্টার সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করছেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের ও পতিত আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের জন্য- এমন অভিযোগ এই সময়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির। এজন্য নিরপক্ষে প্রশাসন গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার দাবি জানাচ্ছে দলগুলো।
গত ১৫ মাস ধরেই রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসন নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে এলেও হালে আরো জোরালো হয়েছে এই অভিযোগ। এ কারণে প্রশাসনে চলে আসা অস্থিরতা আরো জেঁকে বসেছে। শীর্ষ পর্যায়ের আমলা থেকে সবস্তরের কর্মকর্তারা অস্বস্তি রয়েছেন। তাদের মধে চেপে বসেছে একধরনের ভীতি; ফলে কাজের গতিও ছন্দ হারাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি- এই তিনটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ সম্পূর্ণ আলাদা হলেও প্রশাসন ও সরকারের উপদেষ্টাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে একই সুরে কথা বলছে তারা। দলগুলোর অভিযোগের ধরন এবং অবস্থান বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়- তারা শুধু সরকারের ওপর নয়, পরস্পরের বিরুদ্ধেও চাপ সৃষ্টির কৌশল নিয়েছে। নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক প্রভাবের প্রশ্নে এক অঘোষিত প্রতিযোগিতা এখানে দৃশ্যমান বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মাধ্যমে দলগুলো সরকারের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ দলের ওপরও চাপ তৈরি করতে চাইছে।
২০২৪ সালের আগস্টে কোটাবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তখন থেকেই ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবি জানানো হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে। সরকারও প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থা পুনর্গঠন করে এবং নানা উদ্যোগ নেয়। এতে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের পদায়ন করা কর্মকর্তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন।
তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরের বেশি সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিত ও অবসরে যাওয়া বিএনপি-জামায়াতসমর্থিত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে সচিব পদসহ বিভিন্ন পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করেছে পর্যালোচনা কমিটি। আর প্রশাসনে পদোন্নতি পেয়েছেন ১ হাজার ৮১৭ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন ৭৮৫ জন। অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিদের পদ সংখ্যা (প্রেষণসহ) ১ হাজার ৮৩৯টি। অথচ এসব পদের বিপরীতে কর্মকর্তা রয়েছেন ২ হাজার ৯৬৬ জন। এর আগে শীর্ষ পদে একসঙ্গে এতসংখ্যক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাননি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অপর একটি তথ্যসূত্র জানায়, গত এক বছরে সচিব-সিনিয়র সচিব পদের নয়জনসহ মোট ২৯ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ওএসডি, পুলিশ প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মকতা এবং এনবিআরের কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে নানা অভিযোগে। বিভিন্ন অভিযোগে বিভাগীয় মামলারও মুখোমুখি হয়েছেন ও হচ্ছেন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। এসব কারণে প্রশাসনে অস্থিরতা চলে আসছে। ফলে কর্মকাণ্ডেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে বলেও খোদ উপদেষ্টারাই মন্তব্য করে আসছেন। সুযোগ পেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে অস্বস্তির কথা প্রকাশ করছেন সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আওয়ামীবিরোধী হলেও মতের অমিল হলেই তাদরে ‘আওয়ামী লীগের দোসর ট্যাগ’ দেয়া হচ্ছে বলেও ক্ষুব্ধ তারা। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সময়ের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বরাবর প্রশাসনে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ ও নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ বা প্রশ্ন তোলায় খোদ সরকারই বিব্রত অবস্থায় পড়েছে।
গত সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা। বৈঠকে সরকারের কিছু উপদেষ্টা প্রশাসন ও নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে অভিযোগ তুলে তাদের অপসারণের দাবি জানানো হয়। পাশাপাশি বিএনপি ও এনসিপি নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে ফ্যাসিস্টের দোসর কর্মকর্তাদের অপসারণের আহ্বান জানায়। এ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে তুমুল আলোচনা চলছে।
গত ২১ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বৈঠক করে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। বৈঠক শেষে মির্জা আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানকে অর্থবহ নিরপেক্ষ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এই মুহূর্ত থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভ‚মিকায় যেতে হবে। সেজন্য প্রথমেই প্রশাসনকে পুরোপুরিভাবে নিরপেক্ষভাবে তৈরি করতে হবে। সরকারের প্রশাসন যে নিরপেক্ষ, সে ধারণা জনগণের মধ্যে তৈরি করতে হবে। সচিবালয় ও জেলা প্রশাসনে ফ্যাসিস্টের দোসরদের সরিয়ে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ-পদায়ন দিতে হবে। পুলিশের নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে; নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে। বিচার বিভাগে ফ্যাসিস্টদের দোসর সরিয়ে নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। সরকারের মধ্যে অর্থাৎ উপদেষ্টাদের দলীয় লোক থাকলে তাকেও অপসারণের দাবি জানিয়েছেন বলেও জানান মির্জা ফখরুল।
এর পরের দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল। তারাও প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বৈঠক শেষে নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন দেয়া হচ্ছে, সেক্ষেত্রে যোগ্যতার ভিত্তিতে হচ্ছে কিনা- বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগবাঁটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করে এসপি, ডিসির জন্য তালিকা করে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সেই দলগুলোকে সহায়তা করছে। ফলে এভাবে চললে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দলীয় পক্ষপাতের বিষয়টি যেন প্রধান উপদেষ্টা দেখেন, সে বিষয়টি আমরা জানিয়েছি।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠকের পর জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে নির্বাচন কমিশন, সচিবালয় ও পুলিশ প্রশাসনে ৭০-৮০ শতাংশ কর্মকর্তা একটি দলের আনুগত্য করছেন। পুলিশ, জনপ্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশ কিছু কর্মকর্তা বিএনপির প্রতি অনুগত বলে মনে করে জামায়াত। এমন কর্মকর্তাদের তালিকাও করেছে দলটি। এই নেতা কয়েকজন উপদেষ্টার কর্মকাণ্ডের আপত্তির কথা বলেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
এর আগে গত ১৪ অক্টোবর জামায়াত আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের নেতা বলেন, প্রশাসনে যে ষড়যন্ত্র চলছে, এটাকে বন্ধ করুন। নিরপেক্ষ সৎ লোকদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করুন। আর যদি না হয়, কোন কোন উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আমাদের কাছে নাম আছে। ৪-৫ জন উপদেষ্টা একটি দলের হয়ে কাজ করছে। তাদের কণ্ঠ রেকর্ড আছে। সংশোধন না হলে জনসমক্ষে নাম প্রকাশ করে দিব। তিনি আরো বলেন, একটি দলের লোকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে বসিয়ে নীলনকশার নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র চলছে। এতে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্টের দোসররা প্রশাসনে ঘাপটি মেরে আছে, যারা নানাভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে। দলীয়করণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, বিচার ও সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেখানে নতুন কোনো ফ্যাসিবাদ জন্ম নেবে না।
