×

রাজশাহী

বিলুপ্তির পথে চলনবিলের জীববৈচিত্র্য

Icon

মো. মাজেম আলী মলিন, গুরুদাসপুর (নাটোর) থেকে

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:০৯ পিএম

বিলুপ্তির পথে চলনবিলের জীববৈচিত্র্য

ছবি : ভোরের কাগজ

দেশের বৃহত্তম বিল অঞ্চল চলনবিল, যা নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার অংশজুড়ে বিস্তৃত। প্রায় ১,১০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এই বিল একসময় ছিল দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণভূমি-মাছ, পাখি, কৃষি ও সংস্কৃতির মিলিত প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজ সেই চলনবিল মৃত্যুপথযাত্রী।

নদী ও শাখানদীর পলিপ্রবাহে গঠিত এই প্রাকৃতিক জলাভ‚মি বর্ষায় টইটম্বুর থাকলেও এখন মাত্র দুই-তিন মাস পানি থাকে। বছরের বাকিটা সময় বিল শুকিয়ে পরিণত হয় চাষযোগ্য জমিতে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, স্থাপনা নির্মাণ, দখল, দূষণ ও নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারে বিলের প্রাণপ্রবাহ আজ বন্ধপ্রায়।

চলনবিল একসময় ছিল শতাধিক প্রজাতির দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য। স্থানীয় জেলেদের মতে, এখন মাছ ধরার সময় আগের তুলনায় দশ ভাগের এক ভাগও ওঠে না। রিং জাল, চায়না দুয়ারি ও সূক্ষ কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহারে বিলের বাঁচা, গজার, ভেদা, সরপুঁটি, বৌপুঁটি, কড়ি কাইট্যা, কাছিম, ভোদর, জলকলা, গেচু, শৈবালসহ প্রায় ৪০-৫০ প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ বিলুপ্তির পথে।

স্থানীয় প্রবীণ মাছচাষি আফজাল ফকির বলেন, আগে জাল ফেললে ২০-২৫ কেজি মাছ উঠত, এখন ওঠে ২-৩ কেজি। চায়না জালে ছোট মাছ, কাঁকড়া, শামুক- সব ধরা পড়ে। তাই মাছ দিন দিন কমে যাচ্ছে।

পরিবেশবিদদের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই দশকে চলনবিলের দেশীয় মাছের ৬০ শতাংশ প্রজাতি এরইমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে।

মাছের সঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে জেলেদের পেশাও। জীবিকার তাগিদে অনেকে এখন শামুক-ঝিনুক ও কাঁকড়া নিধনে ঝুঁকেছেন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার কুন্দুইল, নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিলশা এলাকায় প্রতিদিন বসছে ‘শামুকের হাট’।

স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রতি রাতেই টন টন শামুক ধরা হয়, যা সকালে প্রতি বস্তা ২০০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এগুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয় হাঁস ও মাছের খাদ্য হিসেবে। প্রতিদিন কয়েক টন শামুক নিধনের ফলে বিলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভয়াবহভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

চলনবিল একসময় ছিল পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্য। শীত এলেই সাইবেরিয়া, কাজাখস্তান ও নেপাল থেকে হাজারো পাখি আসত এখানে। এখন শিকারিরা বন্দুক, ফাঁদ ও বিষ ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত হত্যা করছে বালিহাঁস, পানকৌড়ি, সারস, বকসহ নানা প্রজাতির পাখি।

চলনবিল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আগে বিলের আকাশ ভরে থাকত পাখির ডাকে, এখন নিস্তব্ধ। পাখি হারালে বিলের পরিবেশ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে।

বিলপাড়ের কৃষক গোলাম সরদার বলেন, আগে বিলে মাছ ছিল, পাখি ছিল, গরু চরত। এখন পানি কম, জাল বেশি। সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে।

বিলের অভ্যন্তরে রাস্তা ও ঘরবাড়ি নির্মাণের ফলে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 

নাটোর পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, চলনবিলের অন্তত ৩৫ শতাংশ এলাকা এখন দখল হয়ে গেছে। সিংড়া থেকে গুরুদাসপুর হয়ে চলনবিলে প্রবেশের আত্রাই নদীর প্রায় ২০টি নালা বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলো একসময় চলনবিলের রক্তনালি হিসেবে কাজ করত। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক রূপ ফিরিয়ে আনতে হলে এখনই অভিযান চালিয়ে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ ও নালাগুলোর প্রবাহ ফিরিয়ে দিতে হবে।

গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা আফরোজ বলেন, চলনবিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রশাসন সর্বোচ্ছ গুরুত্ব দিচ্ছে। অবৈধ জাল ধ্বংস ও পাখি শিকার রোধে অভিযান চলছে। এত বিশাল এলাকা রক্ষা করতে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি।

গুরুদাসপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা রতন চন্দ্র সাহা বলেন, দেশীয় মাছ পুনরুদ্ধারে চলনবিলে অভয়াশ্রম গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা ও আইন প্রয়োগ প্রয়োজন।

নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রুহুল আমিন আল ফারুক বলেন, অবৈধ জাল, শিকার ও দখলের কারণে চলনবিলের মাছ, পাখি ও জলজ প্রাণী দ্রæত বিলুপ্তির পথে। চলনবিলকে রক্ষা না করলে শুধু জীববৈচিত্র্য নয়, উত্তরাঞ্চলের জীবিকা ও সংস্কৃতিও হারিয়ে যাবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, চলনবিল বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থা। আগে এখানে শতাধিক প্রজাতির মাছ ও অর্ধশতাধিক প্রজাতির দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি ছিল, যা এখন নেমে এসেছে ২০-৩০ প্রজাতিতে। অবৈধ জাল, রাস্তা-বাঁধ নির্মাণ ও রাসায়নিক পণ্য ব্যবহারে এ বিল দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, চলনবিলকে যদি ‘রামসার ওয়েটল্যান্ড সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা যায়, তবে আন্তর্জাতিক সুরক্ষার আওতায় আনা সম্ভব।

চলনবিল কেবল একটি জলাভূমি নয়- এটি উত্তরাঞ্চলের প্রাণ, সংস্কৃতি ও জীবিকার প্রতীক। কয়েক লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরাসরি এই বিলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু অবাধ দখল, দূষণ ও শিকার চলতে থাকলে অচিরেই এটি হারাবে তার অস্তিত্ব।

স্থানীয়রা বলেন, চলনবিল বাঁচলে বাঁচবে মানুষও। এখন প্রয়োজন সরকারের কঠোর পদক্ষেপ, জনসচেতনতা এবং সম্মিলিত আন্দোলন। ‘বিল বাঁচাও, প্রাণ বাঁচাও’- এখন আর কেবল স্লোগান নয়, এটি টিকে থাকার লড়াই।


সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সাংবাদিক আজীবনই সাংবাদিক

সাংবাদিক আজীবনই সাংবাদিক

বিমানবন্দরে আগুন দেরিতে নেভানোর কারণ জানালেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

বিমানবন্দরে আগুন দেরিতে নেভানোর কারণ জানালেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর প্রতিবাদে ছাত্রদল নেতার ভিডিও বার্তা

মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর প্রতিবাদে ছাত্রদল নেতার ভিডিও বার্তা

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া নিয়ে যা জানালো এনসিপি

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া নিয়ে যা জানালো এনসিপি

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App