চিকিৎসার জন্য বিদেশে বেশি যাওয়া দেশের তালিকায় ১০ম স্থানে বাংলাদেশ
দেশে স্বাস্থ্যসেবায় আস্থার ঘাটতি: আলোচনায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিদেশযাত্রা

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
সরকার ও রাষ্ট্রের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই নিয়মিত চিকিৎসা নিতে বা শারীরিক পরীক্ষার জন্য বিদেশ যান। এক্ষেত্রে তারা বেছে নেন সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের মতো দেশ। অথচ দায়িত্বশীল পদে থেকে তারাই বিভিন্ন সময় দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে বড়াই করে বক্তব্য দেন। কিন্তু নিজের চিকিৎসার জন্য সেই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিটিও দেশের স্বাস্থ্যসেবার ওপর ভরসা না রেখে পাড়ি দেন বিদেশে। আর তখনই দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে সংশয় তৈরি হয় জনমনে। আস্থার সংকট তৈরি হয়। এমন দৃশ্য নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি চিকিৎসার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সিঙ্গাপুর যাওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসার পরই এ নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টিকে নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক ও সমালোচনা। তারা বলছেন, তাহলে কি সংস্কারের বিষয়টি কেবলই কাগজে কলমে আর কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিদেশ যাত্রার বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জুলাই অনলাইন এক্টিভিস্ট ফোরাম (জোয়াফ)। গণমাধ্যমে পাঠানো এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এই আচরণকে ‘জনগণের সঙ্গে তামাশা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা দেখভালের দায়িত্বে আছেন, তার নিজেরই যদি দেশের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থা না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখবে? এই বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সরকারি দায়িত্বে থাকা যে কোনো কর্মকর্তা বা উপদেষ্টা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অবশ্যই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া উচিৎ। বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেয়াকে ‘জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমকে অবিলম্বে দেশে ফিরে এসে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার দাবি জানিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দাবি না মানলে উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে।
এ ঘটনায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। নিজের ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন। যাওয়ারই কথা। কারণ তিনি বাংলাদেশের চিকিৎসার ওপর আগেও আস্থা রাখতে পারেননি, এখনো পারছেন না। আস্থা রাখারই বা কোনো কারণ আছে? সবাই কি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী? স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন। এখনো নিয়মিত চিকিৎসা বা চেকআপ করাতে হয়। সম্ভবত পূর্বে যেখানে চিকিৎসা করিয়েছেন, সেখানেই ফলোআপ করাতে গেছেন। শারীরিক অসুস্থ অবস্থায় তার থেকে চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনও আমি প্রত্যাশা করি না। একজন অসুস্থ মানুষের ওপর উপদেষ্টা নামক পদের বোঝা বাড়িয়ে দিয়ে তাকে আরো অসুস্থ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে রাষ্ট্রের ব্যয়ও বাড়ছে। এই দোষ তো তার নয় বরং যারা তাকে বসিয়েছেন তাদের।
সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল মঙ্গলবার তার ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেন, গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অসুস্থ ভদ্র মহিলার হাতেই দেশের স্বাস্থ্য খাত। এ সময়ে তিনি এত কাজ করেছেন যে, দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে নিজের চিকিৎসার জন্য উপযুক্তও মনে করছেন না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এই যে সিঙ্গাপুরে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, এর খরচটা কে দেবে? উনি নিজে, নাকি সরকার? আমার মনে হয়, এমন নিয়ম করা উচিত মন্ত্রী-এমপি-আমলাসহ সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে দেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করতে হবে। যদি একান্তই বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন স্থানীয় চিকিৎসকরা মনে করেন, সে ক্ষেত্রে ব্যয় নিজেকেই বহন করতে হবে। তাহলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি যেমন হবে, তেমনি জনগণের অর্থেরও অপচয় হবে না।
তবে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার বিষয়টিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং মানবিক জায়গা থেকে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি যতটুকু জানি, নূরজাহান আপা ক্যানসারে আক্রান্ত। তিনি হঠাৎ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে যাননি। অনেক দিন ধরেই সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসায় ধারাবাহিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন অবস্থায় নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর চিকিৎসার হাসপাতাল বা দেশ পরিবর্তন করা বাস্তবে সম্ভব নয়। চিকিৎসার কন্টিনিউশন বা ধারাবাহিকতা ভাঙলে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই বিষয়টিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে না দেখে মানবিক বিবেচনায় দেখা উচিত। একজন মানুষ ক্যানসারের মতো কঠিন রোগের সঙ্গে লড়ছেন, এটাই বড় বিষয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিরা কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশ নির্ভর? রাষ্ট্রীয় খরচে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পরিবর্তে দেশেই কি আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়? উচ্চবিত্তরা কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান? দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা যুগোপযোগী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবা রোগীদের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। নানা অন্তরায় ও সংকটে প্রতি বছর অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে বিদেশমুখী হচ্ছেন। মূলত আস্থাহীনতার কারণেই এ খাতের নীতিনির্ধারকরাও চিকিৎসার জন্য বাইরে যাচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য বিশ্বের যেসব দেশের মানুষ বিদেশে বেশি যায় সেই তালিকার দশম স্থানে বাংলাদেশ। প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি। যাদের এ খাতে ব্যয় হয় অন্তত ৪৮ হাজার কোটি টাকা। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী রোগীদের ৫৩ শতাংশ বিদেশ যান মূলত রোগনির্ণয় বা চেকআপের জন্য।
সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার চিত্র যাচাইয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের উদ্যোগে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি জরিপ করেছে। জরিপের তথ্য বলছে, মানুষ সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। গত বছর ৩৯ শতাংশ মানুষ সরকারি হাসপাতাল থেকে কোনো সেবাই নেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে হৃদরোগ, স্নায়বিক রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি জটিলতা, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, উচ্চরক্তচাপ, আর্থ্রাইটিস এবং মানসিক অসুস্থতার মতো সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। এসব রোগের চিকিৎসায় শতাধিক মেডিকেল কলেজ, একটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ২০টি বিশেষায়িত হাসপাতালসহ নামিদামি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়া ও সেবা অব্যবস্থাপনার রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। রোগীদের পর্যাপ্ত সময় দিতে চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ও আচরণের ঘাটতিসহ অন্তত ২১ কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনেকে আস্থা রাখতে পারছেন না।
এই আস্থাহীনতার কারণ সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা যে সব সমস্যার কথা বলছেন, সেগুলো হলো সরকারি হাসপাতালের সাধারণ বেড পাওয়া থেকে শুরু করে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তিতে দীর্ঘ সিরিয়ালে পড়তে হয়। অনেক সময় পাওয়া যায় না। সরকারিতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি অকেজো থাকায় সময়মতো পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় না। রোগীদের প্রতি চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা অবহেলা করেন। রোগ নির্ণয়ে উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিচালনায় দক্ষ টেকনিশয়ান সংকট ও ওষুধের স্বল্পতা আছে। অন্যদিকে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার মোট ব্যয়ের ৮৯ ভাগ টাকা ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ হয়। এরপরও কাক্সিক্ষত সেবা মেলে না। ফলে বছরে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে যান। চিকিৎসাসেবায় ৫ বিলিয়ন ডলারের মতো বাইরে চলে যাচ্ছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে খান আজাদ বলেছেন, সুযোগসুবিধার স্বল্পতা, চিকিৎসাব্যবস্থায় আস্থার কমতি, সর্বোপরি স্বস্তির অভাবে অসংখ্য লোক দেশের বাইরে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। সমস্যাগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করা ও সমাধানের মাধ্যমে রোগীদের বিদেশমুখিতা কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সহসভাপতি অধ্যাপক জাফরউল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, দেশে অনেক ক্ষেত্রে রোগ পরীক্ষা ঠিক হয় না, টাকা অনেক বেশি নেয়া হয় এবং সেবাদানকারীদের ব্যবহার ভালো না হওয়ায় রোগীরা বিদেশমুখী হচ্ছে।
এদিকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার ঘাটতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি মানুষের পূর্ণ আস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। উন্নত চিকিৎসার আশায় প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ বিদেশে গিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন। অথচ পরিস্থিতি উল্টো হওয়ার কথা ছিল চিকিৎসার জন্য মানুষকে বাংলাদেশে আসতে আকৃষ্ট করার মতো সক্ষমতা আমাদের গড়ে তোলা উচিত ছিল। আমাদের দেশে বড় বড় অবকাঠামো নির্মিত হলেও সেখানে পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তার থাকলেও নার্স নেই। দক্ষ জনবলের এই সংকটে সাধারণ মানুষ মানসম্মত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগকারীদের উচিত সাধারণ মানুষের সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করে স্বল্পমূল্যের হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে তোলা।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআরবি) চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. আহমেদ এহসানুর রহমানের মতে, ইউরোপ-আমেরিকার মতো টেকনোলজি না থাকার পর ভারত ও থাইল্যান্ড মডেল রোগীদের আস্থা ও প্রশান্তিদানে সক্ষম হয়েছে। রোগীরা সেখানে ঝোঁকছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীদের বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি, শান্তি দেয়ার কাজটি জরুরি। টেকনোলজি অগ্রসর ও কোলাবরেশনের মাধ্যমে কম খরচে সেবা দিতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়ন দরকার। না হলে রোগী ধরে রাখা যাবে না।