জুলাই সনদ
বল এখন সরকারের কোর্টে
হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৫৩ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
রাজনৈতিক ৩০টি দল ও অন্তর্বর্তী সরকার ২৭০ দিন ঐক্যের পথেই হেঁটেছে। আর এর মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যার ফসল ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। কিন্তু এই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি, গণভোট ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ঘিরে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে গোল বেঁধেছে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা নিয়েও। এখানে বিএনপির ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট বাদ দেয়া হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে গণভোটের সময় নির্দিষ্ট করা না হলেও নির্বাচনের দিন বা আগে অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ২৭০ দিন সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে এবং এই সময়ে জুলাই সনদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে সুপারিশে। তার আগে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন জারি করবে অন্তর্বর্তী সরকার। এখানেই ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
দলগুলো বলছে, জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে পারে না। জুলাই সনদে যে অংশে সই করা হয়নি তার দায় বিএনপি নিবে না। অবশ্য জুলাই সনদ বাস্তায়নের সুপারিশ নিয়ে জামায়াতের কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। তবে তারা চাইছে, গণভোট নভেম্বরে হতে হবে ও সনদ বাস্তবায়নের আদেশ প্রধান উপদেষ্টাকে জারি করতে হবে। এ নিয়েই বিরোধ চরমে পৌঁছেছে দলগুলোর মধ্যে। জুলাই সনদ ইস্যু নিয়ে রাজনীতি এখন ঘোলাটে। এই সমস্যার সমাধান কোথায়?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বল এখন সরকারের কোর্টেই রয়েছে। সরকারের পদক্ষেপ ঘিরে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে; তার সমাধানে ধনন্তরী ওষুধও সরকারের হাতেই রয়েছে। এক বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার ঐক্যের পথেই হেঁটেছে। দলগুলোও চাইছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসে সমঝোতায় পৌঁছাতে। এমনকি সরকারের তরফ থেকেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানানো হয়েছে; বলা হয়েছে জুলাই সনদ ও গণভোটের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। এতে রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং নির্বাচনের পথ সুগম হবে।
রাষ্ট্র সংস্কারের অন্তর্বর্তী সরকারের বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়। এতে ২৫টি দল স্বাক্ষর করে। তবে সরকারের অংশীজন দল এনসিপি এতে স্বাক্ষর করেনি। এছাড়া সিপিবিসহ চারটি দলও স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য থাকায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ২৮ অক্টোবর সরকারের কাছে সুপারিশ দেয়। এদিকে সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিএনপি ও সমমনা জোট, বামসহ কয়েকটি দল, জামায়াত ও তার সমমনা কয়েকটি ইসলামী দল এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি পরস্পরের বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন বানচালের অভিযোগ তুলছে। এমনকি সরকার কোনো রাজনৈতিক দলরের পক্ষপাতিত্ব করছে বলেও অভিন্ন অভিযোগ পক্ষ তিনটির। জামায়াতসহ যুগপৎ আন্দোলনের শামিল ৮টি ইসলামী দল ও এনসিপি চাইছে আদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি। আর এজন্য চলতি নভেম্বরেই গণভোট অনুষ্ঠানের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে থেকে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বৃহস্পতিবার বলেছেন, গণভোট কবে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ তীব্রতম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে আমরা সহায়তা করার জন্য থাকব। সিদ্ধান্ত কেউ এককভাবে নেবেন না, এটা আপনারা নিশ্চিত থাকেন। দ্রুতই এই সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টা নেবেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, জুলাই সনদে আমরা যে অংশে সই করেছি, তার দায়দায়িত্ব আমরা নেব। কিন্তু যেটা আমরা সই করিনি, সেটার দায় আমরা নেব না। তিনি বলেন, আমরা সনদে সই করার সময় বলেছিলাম, যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেগুলো সই হবে। যেসব বিষয়ে একমত হবে না, সেগুলো নোট অব ডিসেন্ট হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখই নেই। আমাদের বক্তব্যগুলো বেমালুম বাদ দেয়া হয়েছে, বরং নতুন কিছু বিষয় যোগ করা হয়েছে- এটা জনগণের সঙ্গে নিঃসন্দেহে প্রতারণামূলক কাজ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, দুই থেকে তিনটি দলের মতামত বিএনপির ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ঐকমত্য হয়েছে, সই হয়েছে, এর বাইরে গিয়ে এখন নতুন নতুন দাবি নিয়ে আসছে। এখানে আবার ঐকমত্য কমিশনের নিজস্ব মতামতও আছে। তাদের তো এখানে মতামত দেয়ার জন্য রাখা হয়নি। ঐকমত্য কমিশনে যারা আছেন, তারা নিজ নিজ কাজে ফিরে যান। জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। এই নির্বাচনকে যারা ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়, বিলম্বিত করতে চায়, প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়- তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। এ নির্বাচনকে বিলম্ব করার ষড়যন্ত্র চলছে, কিন্তু জনগণ তা মেনে নেবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, দেশের জনগণের জুলাই সনদের দরকার নেই। জনগণের প্রয়োজন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। একটি সংসদ প্রয়োজন, যারা গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করবে। এই জুলাই সনদ মূলত উপদেষ্টাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য কাজে লাগবে, জনগণের স্বার্থে নয়। ঐকমত্য কমিশন জোর করে সনদে ঢুকিয়ে দিয়েছে মন্তব্য করে মেজর হাফিজ বলেন, নির্বাচন হওয়ার স্বার্থে অনিচ্ছা সত্তে¡ও বিএনপি অনেক কিছু মেনে নিয়েছে। সব দল যেসব বিষয়ে একমত হবে, তা নিয়ে সনদ হবে। আমরা ডিসেন্ট দেখতে চাই না। এখন প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন এবং ক্ষমতায় এলে বিএনপি যৌক্তিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের ভুলিয়ে দিতে এ অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেনি তিনি। তিনি হুঁশিয়ারি দেন, আজ ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র করছে; বানচালের চেষ্টা করছে। তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, কতগুলো বিষয়ে আদর্শিক ভিন্নমতের কারণে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সনদে স্থান পায়নি বলে মনে হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানের কোথাও গণভোটের কথা নেই উল্লেখ করেন তিনি বলেন, এই গণভোটের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয় না। ১১টার মধ্যে ৫টা সংস্কার কমিশনের কোনো খবর নেই। আবার ৬টা সংস্কার কমিশনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার ছাড়া অন্য কোনো সংস্কার কমিশন নিয়ে আলোচনাই হয়নি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, ঐকমত্য কমিশন অনৈক্যের একটা দলিল জাতির কাছে হাজির করেছে। জাতীয় নির্বাচনের শাশ্বত পথে প্রবেশ না করা পর্যন্ত কোনো কিছুর সমাধান আসবে না।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশকে কলঙ্কিত করা হয়েছে। সেই পদ্ধতি বহাল রেখে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না, জনগণের সরকার গঠিত হতে পারে না।
তিনি বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের সর্বোত্তম পদ্ধতি হচ্ছে পিআর পদ্ধতি। পিআর পদ্ধতিতে ভোট হলে কেউ ভোট চুরি করতে পারবে না, কেন্দ্র দখল দিতে যাবে না, মনোনয়ন-বাণিজ্য হবে না। ফলে কালোটাকার ছড়াছড়িও বন্ধ হয়ে যাবে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে এবং প্রতিটি ভোটের মূল্যায়নের মাধ্যমে জনগণের সরকার গঠিত হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহবায়ক সারোয়ার তুষার গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত করার আগেই জুলাই সনদ স্বাক্ষরের নামে মহাপ্রতারণা অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়, সেখানে জাতীয় নাগরিক পার্টি অংশ নেয় নাই। কারণ আমরা বলেছি, জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সেই পদ্ধতি যতক্ষণ পর্যন্ত আপনারা না বলবেন, (ততক্ষণ) আমরা কিন্তু জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারি না।
