হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়
মেজর সিনহা হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ওসি প্রদীপ, গুলি করেন লিয়াকত
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
পুলিশের টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী (মাস্টারমাইন্ড)। আর সাবেক পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তার হাতে থাকা সরকারি পিস্তল দিয়ে সিনহাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরপর চারটি গুলি করেছেন এবং গুলির আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসেছে।
এর আগে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড এবং অপর ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখে গত ২ জুন রায় দেন বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। ৩৭৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি রোববার (২৩ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। রায়টি বাংলায় লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান, যার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের অপর বিচারপতি মো. সগীর হোসেন।
হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী প্রদীপ
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রদীপ কুমার দাশ আলোচ্য হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড, পরিকল্পনাকারী ও ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সে ভিকটিম মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বুকের বাম পাঁজরে জুতা পরা পা দিয়ে জোরে আঘাত করে তার বুকের দুটি হাড় ভাঙাসহ ভিকটিমের গলার বাম পাশে জুতা পরা পা দিয়ে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, যা প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যসহ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে প্রমাণিত।’
পূর্বপরিকল্পনামতে লিয়াকত উপস্থিত হয়ে গুলি করেন
প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য, দণ্ডপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট আসামিদের অপরাধ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও শক্তিশালী পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে রায়ে আদালত বলেন, এটি প্রমাণিত হয়েছে যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামি লিয়াকত আলী পূর্বপরিকল্পনামতে ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাঁর হাতে থাকা সরকারি পিস্তল দিয়ে নিরস্ত্র মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পরপর চারটি গুলি করেছেন এবং গুলির আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
যে কারণে প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড বহাল
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ‘যেহেতু আসামি প্রদীপ কুমার দাশ আলোচ্য হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী এবং ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ভিটকিম মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বুকে আঘাত করে বুকের দুইটি হাড় ভাঙাসহ গলার বাম পার্শ্বে পা দিয়ে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে এবং অপর আসামি লিয়াকত আলী পূর্বপরিকল্পনা মতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে ভিকটিমের ওপর পরপর চারটি গুলি করেছে এবং এই গুলির আঘাতেই মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যু হয়েছে বলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেহেতু আসামি প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীকে বিচারিক আদালত সঠিকভাবে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় উল্লেখিত সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন।’
সিনহাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও গতিবিধির ওপর নজর
প্রসিকিউশনের পক্ষের সাক্ষ্য, দণ্ডিত পাঁচ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য ও উভয় পক্ষের বক্তব্য পর্যালোচনা করে রায়ে আদালত বলেছেন, ‘মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান ‘জাস্ট গো’ নামে ইউটিউবের জন্য পাহাড়, জঙ্গল, সি-বিচ এলাকার ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণের জন্য ২০২০ সালের ২ জুলাই সাহেদুল ইসলাম ও শ্রিপা দেবনাথ ও রুপ্তিসহ কক্সবাজার পৌঁছান। পরবর্তীতে ৭ জুলাই নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করে তাদের পূর্বপরিকল্পনামতো কক্সবাজার, টেকনাফ ও রামু এলাকার বিভিন্ন স্থানের ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণ করার সময় স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তাঁর বাহিনীর কয়েক সদস্যের চাঁদা আদায়, গুম, ক্রসফায়ারসহ বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপের বিষয়ে অবগত হয়। ভুক্তভোগীদের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ করেন, যা প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্যে প্রমাণিত।’
রায়ে আরও বলা হয়, বিষয়টি প্রদীপ কুমার দাশ সোর্সের মাধ্যমে অবগত হয়ে ভিকটিম মেজর (অব.) সিনহাকে ওই কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য ২০২০ সালের জুলাইয়ের মধ্যভাগে হুমকি দিয়ে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়, যা প্রসিকউশনপক্ষের সাক্ষ্য ও শক্তিশালী পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত। আসামি প্রদীপ কুমার দাশের ওই ধরনের হুমকির পরও ভিকটিম (সিনহা) তার দলবলসহ ওই এলাকা ত্যাগ না করে বরং তার কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়াকালে প্রদীপ কুমার দাশ সঙ্গীয় লিয়াকত আলী, নন্দদুলাল রক্ষিত, সাগর দেব, রুবেল শর্মা, মো. রুহুল আমিন, মো. আইয়াজ ওরফে আয়াছ ও মো. নিজাম উদ্দিন ভিকটিম মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে এবং ভিকটিমের গতিবিধির ওপর নজর রেখে তথ্য প্রদানের জন্য সোর্স হিসেবে আসামি নুরুল আমিন, আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সিনহা ও সায়েদুল ইসলাম টেকনাফ থানার মারিশবুনিয়া মুইন্না পাহাড়ে অবস্থান করে ভিডিও ও স্থিরচিত্র ধারণ করে নীলিমা রিসোর্টে ফিরে আসার সময় ওই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাদের ডাকাত সাব্যস্ত করে গণপিটুনিতে হত্যা করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় উম্মুল কুরআন জামে মসজিদের মাইক থেকে মুইন্না পাহাড়ে ডাকাত এসেছে বলে আসামি নিজাম উদ্দিন মাইকিং করে, যা আসামি নুরুল আমিন, মো. আইয়াজ ও নিজাম উদ্দিন অপরাধ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও প্রসিকিউশন পক্ষের দুজন সাক্ষীর সমর্থনীয় সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণিত।
যে কারণে ছয় আসামির যাবজ্জীবন বহাল
হাইকোর্টের রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকা ছয় আসামি হলেন সাবেক এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব, কক্সবাজারের বাহারছড়ার মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিন। ওই ছয় আসামির বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, আলোচ্য হত্যাকাণ্ডে ষড়যন্ত্র, সহায়তা ও সাধারণ অভিপ্রায়ের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় বিচারিক আদালত তাঁদের করা অপরাধের ধরন বিচার-বিশ্লেষণ করে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় উল্লিখিত মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছেন, যা সঠিক ও যুক্তিযুক্ত বলে আমরা মনে করি। সে কারণে রায়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো অবকাশ নেই।
মামলার পূর্বাপর
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সিনহা। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত রায় দেন। রায়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স ২০২২ সালে হাইকোর্টে আসে। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা পৃথক জেল আপিল ও আপিল করেন। এছাড়া বিচারিক আদালতের রায়ে খালাসপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে এবং যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ছয়জনের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে মামলার বাদী ও সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস হাইকোর্টে ফৌজদারি রিভিশন আবেদন করেন।
ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করে, দণ্ডিত আসামিদের জেল আপিল ও আপিল নামঞ্জুর করে এবং বাদীর রিভিশন আবেদন (রুল খারিজ) খারিজ করে গত ২ জুন রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। পূর্ণাঙ্গ রায়টি আজ সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
