×

মতামত

শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব: বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ০২:২৩ এএম

শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব: বৈষম্য দূর করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান

শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে শিক্ষার্থীদের উল্লাস। ছবি: রাজিব ধর/এপি

একটি নৈতিক বিপ্লব, যা শুধু সরকার নয়—সমাজের বিবেককেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখন আর নিছক শ্রেণীকক্ষের পাঠেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা রাস্তায়, চত্বরে, ডিজিটাল মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে জোরালো কণ্ঠে বলছে—এ দেশের কাঠামোগত বৈষম্য, দুর্নীতি ও সুবিধাবাদ আর চলতে পারে না। এই তরুণদের নৈতিক জাগরণ কেবল একটি সরকারের পতনের প্রতীক নয়, বরং একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা।

এটা আর শুধু প্রতিবাদ নয়—এটা এক নৈতিক অভ্যুত্থান। রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা কোনো দলীয় চেতনার বাহক নয়, বরং তারা এক দগ্ধ সমাজের বিবেক হয়ে উঠেছে। তাদের চোখে লজ্জা, প্রশ্ন, এবং জেগে ওঠা মূল্যবোধ—যা রাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন বৈষম্য ও সুবিধাভোগী শ্রেণিকাঠামোর বিরুদ্ধে এক অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। দুর্নীতির অন্ধকার গলিতে যখন ন্যায়বিচার নিঃশব্দে কাঁদে, তখন এই তরুণরাই বলে ওঠে: “আমরা চুপ থাকবো না।”

তারা আজ দাবি করছে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার, যেখানে শিক্ষক, কৃষক, গৃহকর্মী কিংবা ঝাড়ুদার—সবাই পাবেন সম্মান, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা। রাষ্ট্র যদি কেবল কিছু মানুষের সম্পদের পাহারাদার হয়ে থাকে, তবে সেটি আর জনতার রাষ্ট্র নয়। এই আন্দোলন সেই ব্যবধান ভাঙতে এসেছে—চেতনাকে বদলাতে, কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে। এটি কোনো গুজবনির্ভর আবেগ নয়—এটা এক বিবেকসচেতন, তথ্যভিত্তিক বিপ্লব।

বছরের পর বছর ধরে একটি ক্ষুদ্র, শক্তিশালী শ্রেণি সরকারি প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য উচ্চপদে থেকে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে আসছে। তাঁরা চাকরি চলাকালীন উচ্চ বেতন, নানা ভাতা এবং অবসরে প্রতীকী মূল্যে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্লট পাচ্ছেন। অথচ যারা শিক্ষকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিকাজ, শ্রম কিংবা সাধারণ সরকারি চাকরিতে দেশের প্রকৃত সেবা করে যাচ্ছেন—তাঁদের জন্য নেই সম্মানজনক অবসরজীবন কিংবা ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা।

এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা পাঁচটি স্পষ্ট দাবিতে সংক্ষেপ করা যায়:

১. ঢাকার চাপ কমাতে সেনানিবাস, প্রশাসনিক ভবন ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন জরুরি

ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ, যানজটপূর্ণ ও দূষিত শহর। অথচ এই শহরের কেন্দ্রস্থলেই অবস্থিত রয়েছে সেনানিবাস, মন্ত্রণালয়, সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো বহু দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, যা বিকল্প স্থানে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব।

এছাড়া, হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ—বিশেষ সুবিধাসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বসবাস করছেন। তাঁদের জন্য রাজধানীর বাইরে আধুনিক ও সম্মানজনক আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে নাগরিক সুবিধা সবার জন্য উন্মুক্ত হয় এবং রাজধানীর ভারসাম্য রক্ষা পায়।

রাজধানীকে শুধু ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ না রেখে একটি বসবাসযোগ্য মানবিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানচ্যুতি এখন সময়ের দাবি।

২. পরিশ্রমজীবী মানুষ যেন আর বস্তিতে না বাস করেন  

যারা বাস চালান, রাস্তায় ঝাড়ু দেন, বিভিন্ন সেবা দেন—তাঁরা যেন সারাজীবন কাজ করেও বস্তিতে বাস করতে বাধ্য না হন। এটি রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। তাঁদের জন্য ন্যূনতম আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও অবসরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

৩. দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলোকে ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে দূষিত করে রাখা চলবে না  

দুর্নীতি দমন কমিশন, আয়কর বিভাগ, ভূমি অফিসসহ সরকারি রাজস্ব ও জবাবদিহির সংস্থাগুলোর ভেতরে ঘুষ ও অবৈধ সমঝোতার চক্র গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন, কার্যকর ও জনদায়িত্বশীল করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না।

৪. নৈতিক শিক্ষা দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ শুরু করতে হবে  

বিচার বিভাগ, প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনৈতিকতা বাড়ছে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল আইন দিয়ে নয়—শুরু করতে হবে শিক্ষালয় থেকে। শিশুদের মধ্যে ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাস, আত্মসংযম, দায়িত্ববোধ ও অসততার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

৫. যারা সেবা দেন, তাঁরা যেন সম্মান ও নিরাপত্তা পান  

অফিসের গাড়িচালক, বাসার সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী কিংবা কৃষক—যারা নীরবে সেবা দিয়ে যান—তাঁরা যেন অবহেলার শিকার না হন। তাঁদের জন্য পেনশন, চিকিৎসা ও অবসরের সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা থাকা উচিত। এই অবহেলা মানবিকতাবিরোধী এবং রাষ্ট্রীয় নীতির চরম ব্যর্থতা।

এই শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন একটি মূল্যবোধভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের ডাক দিয়েছে। এটি কেবল রাজনৈতিক নয়—এটি এক নৈতিক পুনর্জাগরণ। এখন সময় এই তরুণদের কণ্ঠস্বরকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করার। সময় এসেছে একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও ন্যায়ের বাংলাদেশ গড়ার।

এই আন্দোলন শুধু পাঁচটি দাবি পূরণের জন্য নয়—এটি রাষ্ট্রকে তার আয়নায় নিজের মুখ দেখানোর আহ্বান। আমরা কীভাবে এতদিন কিছু মানুষকে বিশেষ সুবিধার পাহাড়ে বসিয়ে রেখেছি, আর যারা প্রকৃত সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের ঠেলে দিয়েছি অবহেলার প্রান্তে? তরুণরা সেই প্রশ্ন তুলছে, এবং সেই প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া মানেই ভবিষ্যতের দায় এড়িয়ে যাওয়া।

এখন আর কেবল সরকারি নীতিমালার কসটিতে চলা চলবে না—চাই নতুন রাষ্ট্রচিন্তা, যেখানে মূল্যায়ন হবে সেবার ভিত্তিতে, সুবিধার নয়। এই আন্দোলনের অন্তরে যে নৈতিক সুর বাজছে, তা কোনো সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাংলাদেশের আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা এক ধ্বনি—ন্যায়ের, মর্যাদার ও গণতন্ত্রের। যারা আজ রাস্তায় দাঁড়িয়েছে, তারা কেবল বিদ্রোহ করছে না—তারা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে।

এখন সময় এসেছে কানে শোনা নয়—হৃদয়ে ধারণ করার। এই তরুণ কণ্ঠস্বর যদি অবহেলা করা হয়, তবে রাষ্ট্র শুধু একটি প্রজন্ম নয়—হারাবে নিজের ভবিষ্যৎ, মানচিত্র ও আত্মপরিচয়।  নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে চাই ন্যায়ের ভিত্তিতে মর্যাদা, চাই মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা।  এই বিপ্লবের আত্মত্যাগ তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন রাষ্ট্র নিজেই উচ্চারণ করবে—  সবাই গুরুত্বপূর্ণ, কেবল সুবিধাভোগীরা নয়।

রহমান মৃধা, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

গোপনে যে শর্তে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল সৌদি

গোপনে যে শর্তে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল সৌদি

জানা গেল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ

জানা গেল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ

পুতুলকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠালো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

পুতুলকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠালো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

নিজের চোখ নিয়ে মহৎ সিদ্ধান্ত হৃত্বিকের

নিজের চোখ নিয়ে মহৎ সিদ্ধান্ত হৃত্বিকের

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App