×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতি নয়, দেশ আগে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:১৭ পিএম

রাজনীতি নয়, দেশ আগে

সবার আগে দেশ

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটজনক হয়ে উঠেছে। যদি আমরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা অনিবার্যভাবে হার স্বীকার করতে বাধ্য হব। কিন্তু এটি কি শুধুই ব্যক্তিগত পরাজয়ের গল্প? না। এটি একটি সমষ্টিগত মনস্তাত্ত্বিক ধ্বস, যা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, সম্পর্ক ভাঙায় এবং সমাজের অন্তর থেকে আশা শুষে নেয়। যেখানে দুর্নীতি, অত্যাচার, অবিচার এবং মিথ্যা অভিযোগ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে মানুষ সেগুলো দেখার সুযোগ এবং সাহস খুঁজে পাচ্ছে না, সেখানে অস্থিরতা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে চলেছে হৃদয়ে। এই অস্থিরতা কাটাতে আমাদের সকলকে একযোগে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং সকল ষড়যন্ত্র ভেঙে দিতে হবে। আমরা দীর্ঘ প্রায় পনেরো মাস অপেক্ষা করেছি একটি জুলাই সনদের জন্য, আজ যখন সেটা জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হয়েছে তার প্রতি অবমাননা?

একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য হলো জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে একটি নতুন রাজনৈতিক চুক্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সেই চুক্তির বাস্তবায়নের প্রথম শর্তই হচ্ছে গণভোট। গণভোটটি জুলাই সনদের ভিত্তিতেই হওয়া উচিত এবং তা জাতীয় নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন করা জরুরি। নইলে প্রশ্ন উঠবে, জুলাই সনদের প্রয়োজনই বা কী? এখনই যদি সেই সনদের প্রতি অবমাননা বা অগ্রাহ্য করার মনোভাব দেখা দেয়, তাহলে জনগণ কীভাবে বিশ্বাস করবে যে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গেলে সনদটি কার্যকর হবে?

অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা দেখেছি, ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যে প্রতিশ্রুতিগুলো তারা দিয়েছে, ক্ষমতায় গিয়ে তা বাস্তবায়ন করেনি। এই অভিজ্ঞতা জনগণকে হতাশ ও অবিশ্বাসী করে তুলেছে। তাই জুলাই সনদ এমনভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে তা মানার বাধ্যবাধকতা স্পষ্ট থাকে এবং অবমাননার কোনো সুযোগ না থাকে। এই চুক্তিকে যদি আবারও কাগজে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়, তবে সেটি হবে জাতির প্রতি আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতা।

পরবর্তী সতর্ক সংকেত রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে যদি কেউ অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে বা দেশকে অচল করার চেষ্টা করে, তবে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়াতে পারে যে জাতিসংঘকেই শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে। প্রয়োজনে তারা সাময়িক সামরিক প্রশাসনের অনুমোদন দিতেও বাধ্য হতে পারে, যাতে আন্তর্জাতিক অরাজকতা রোধ করা যায়। বিশেষ করে ভারত এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার যুক্তিতে সমর্থন দেবে বলেই সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে জনগণের ক্ষতি হবে, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর বারোটা বেজে যাবে তারা আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়বে, যাতে ভবিষ্যতে রাজনীতি করার সাহসও না থাকে। অতএব প্লিজ think before after নইলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ, সবার মধ্যে পরাজয়ের আতঙ্ক সৃষ্টি হবে।

পরাজয়ের অনুভূতি যত গভীর হবে তত বেশি মানুষ আত্মরক্ষার পথ গ্রহণ করবে। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে জন্ম নেয় সন্দেহ, প্রতিহিংসা এবং ভুল বোঝাবুঝি। যখন প্রত্যেকে শুধু নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় লড়াই করে, তখন সহানুভূতির জায়গা শূন্য হয়ে পড়ে। পারিবারিক দ্বন্দ্বে ভালোবাসার বদলে ঘৃণা জমে। ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক দ্বন্দ্বেও মিশ্র আবেগ সমাজকে ভিতরের দিকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারে। আর কেউ যদি বলে আমি শুধু হেরেছি, তুমি কি একটুও হারোনি, তখন সেই প্রশ্নই আস্থা ভাঙায় এবং সবচেয়ে ভয়ানক ভূমিকা নেয়।

মুক্তির পথ কেবল স্লোগানের ইস্যু নয়। এটিকে নীতি, কৌশল এবং ধারাবাহিক অনুশীলনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। তার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত অপরিহার্য  স্বচ্ছতা, সহমর্মিতা এবং সংহত আন্দোলন। অভিযোগ যদি প্রকাশ্য না হয় এবং তদন্ত স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষভাবে না হয়, তাহলে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ ও গুজব আগুনের কাজ করবে। দায়িত্বশীল ও স্বচ্ছ তদন্ত ব্যবস্থা গড়তে হবে। দোষীদের বিচার করতেই হবে, কিন্তু মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখার আগ্রহ হারালে পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসনের পথ বন্ধ হয়ে যায়। সহমর্মিতা ছাড়া কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ভাগ হয়ে থাকা প্রতিবাদ ভাঙনই বাড়ায়। পরিকল্পিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নীতিভিত্তিক আন্দোলনই টেকসই পরিবর্তন আনতে পারে। পাশাপাশি আইনি ও নৈতিক জবাবদিহি নিশ্চিত করে ক্ষমতার অপব্যবহার দমন করতে হবে।

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে মৌলিক কাঠামোগুলো প্রয়োজন, সেগুলো আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কেন পৌঁছেছে, এই প্রশ্ন আমাদের সবাইকে ভাবতে বাধ্য করছে। কীভাবে সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব? নির্বাচন কি একমাত্র সমাধান? বাংলাদেশ আদৌ নির্বাচন সম্পর্কে সচেতন ছিল কি? একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অবকাঠামো কিভাবে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে? রাষ্ট্রযন্ত্র বলতে আমরা বুঝি আইনপ্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান, নির্বাহী বিভাগ, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনী কাঠামো এবং তথ্যমাধ্যম। এগুলো একত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রাখে। যখন এই স্তরগুলো দুর্বল হয়, তখন রাষ্ট্র কেবল নামমাত্রই থাকে। তখন নীতি, ন্যায় ও দায়িত্ববোধ ভেঙে পড়ে এবং দুর্নীতি ও শক্তির অপব্যবহার সমাজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বসে যায়।

নির্বাচন একটি শক্তিশালী প্রক্রিয়া, কিন্তু এটি নিজে এককভাবে কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোকে শুধরাতে পারে না যদি পরিবেশ নিরপেক্ষ না থাকে। নির্বাচন যদি হয় কেবল ফর্মালিটি, ভোটচুরি ও প্রভাবের মাধ্যমে পরিচালিত, তাহলে তা জনগণের আস্থা হারায়। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ন্যায্য, মুক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে না পারলে নির্বাচন কেবল আড়ম্বর হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানগত শিক্ষা ও নাগরিক সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ভোটাররা নির্বাচনকে অনেক সময় শুধু একটি ইভেন্ট মনে করেন, যেখানে কাগজে চিহ্ন দেয়া হয়। সচেতন নাগরিক হওয়ার মানে হলো প্রার্থীর নীতি যাচাই করা, তাদের অনুপ্রেরণা বোঝা, এবং ভোটের ফলাফল ধরে রাখার দায়বদ্ধতা পালন করা। এই সচেতনতা গড়ে ওঠে মিডিয়ার স্বাধীনতা, নাগরিক শিক্ষা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিচারব্যবস্থার স্বতন্ত্রতার মাধ্যমে। যখন এগুলো দুর্বল থাকে, তখন নির্বাচনও দুর্বল হয়।

দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামো জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। বরং তা ক্ষমতাসীনদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ দেয় নিজের অবস্থান দীর্ঘায়িত করার। দুর্নীতি নীতিগত স্বার্থ বিকৃত করে এবং নাগরিকের বিশ্বাস ধ্বংস করে। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সততা, জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক নীতি। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের ভেতরে স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে, তাহলেই বাহ্যিক নির্বাচনে সঠিক প্রতিনিধিত্ব সম্ভব।

রাষ্ট্রযন্ত্রকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন কিছু মৌলিক পদক্ষেপ  বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রশাসন গড়ে তোলা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহ বাড়ানো, দমনমূলক আইন পর্যালোচনা করে নাগরিক অধিকার রক্ষা করা, নাগরিক শিক্ষা ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর অডিট ও সম্পদ বিবরণী ব্যবস্থা চালু করা এবং সংগঠিত, নীতিভিত্তিক অভ্যন্তরীণ আন্দোলন গড়ে তোলা।

হেরে যাওয়া মানে মরে যাওয়া নয়  এই ধারণাটি আমাদের বদলাতে হবে। পরাজয় যদি আত্মসমর্পণ হয়, তা সমাজকে ধ্বংস করবে। কিন্তু পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, কথা বলার দরজা খোলা রাখি, এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনরুজ্জীবিত করি, তবে সেই একই পরিস্থিতিই হতে পারে মুক্তির পথ। রাষ্ট্রের যন্ত্রকে রক্ষা করা শুধু প্রশাসনিক কাজ নয়, এটি সামাজিক চুক্তি রক্ষা করা। এর জন্য প্রয়োজন ন্যায়, স্বচ্ছতা এবং সক্রিয় নাগরিক অংশগ্রহণ।

লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

এবার নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীর নামে মামলা যুবদল নেতা নয়নের

এবার নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীর নামে মামলা যুবদল নেতা নয়নের

পিএসসির সামনে অ্যাকশনে সেনাবাহিনী

পিএসসির সামনে অ্যাকশনে সেনাবাহিনী

বিএনপির প্রার্থী তালিকায় নেই যেসব প্রভাবশালী নেতার নাম

বিএনপির প্রার্থী তালিকায় নেই যেসব প্রভাবশালী নেতার নাম

তিন আসনে লড়বেন খালেদা জিয়া, তারেক রহমান একটিতে

তিন আসনে লড়বেন খালেদা জিয়া, তারেক রহমান একটিতে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App