কপ ৩০ সম্মেলনের ২য় দিন
সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ন্যায্যতা বাস্তবায়নে তাগিদ
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৪২ পিএম
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। ফাইল ছবি
২০২৫ সালের ১০ নভেম্বর ব্রাজিলের আমাজনের কোল ঘেঁষে অবস্থিত বেলেম শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে ৩০তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন (কপ ৩০)। গত সোমবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ১১ দিনব্যাপী এই সম্মেলন, যা ২১ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। ১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি) থেকেই কনফারেন্স অব দ্যা পার্টিস (কপ)-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিনে প্রথম কপ অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এবছরে অনুষ্ঠিত ৩০তম অধিবেশন আবার ফিরেছে ল্যাটিন আমেরিকার মাটিতে। এবারের আয়োজক শহর বেলেম কেবল ভূগোলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং শহরটির অবস্থান বিশ্বের বৃহত্তম রেইনফরেস্ট এবং পৃথিবীর ‘ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিত আমাজনের নিকটবর্তী। তাই বেলেমকে আয়োজক শহর হিসেবে নির্বাচনও গভীর প্রতীক বহন করে। তবে, বেলেমের তীব্র ও অসহনীয় তাপমাত্রা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের জন্য ব্যাপক ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচণ্ড গরমের পর এক পশলা বৃষ্টি যেন ক্লান্ত শহরে এনে দিল খানিকটা শান্তি। বেলেমের এই আবহাওয়া বিশ্বকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে বন সংরক্ষণ, বাস্তুসংস্থান রক্ষা, এবং টেকসই উন্নয়ন শুধু পরিবেশগত আলোচনার অংশ নয়, বরং জলবায়ু নীতির কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্টে কপ ৩০-এর আয়োজন নিছক প্রতীকী সিদ্ধান্ত নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের চরম সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বাস্তবসম্মত, টেকসই, এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান অনুসন্ধানের এক ঐতিহাসিক অনন্য মুহূর্ত। এই বছরের কপ সম্মেলনের মূল স্লোগান “ গ্লোবাল মুতিরা ”, একটি স্থানীয় উপজাতীয় শব্দ, যার অর্থ সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
সম্মেলনের প্রথম দিন থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, দ্রুত কার্বন কমানো, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা হ্রাস, জলবায়ু অর্থায়নের স্বচ্ছ ও ন্যায্য রোডম্যাপ, এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য লস ও ড্যামেজ ফান্ড নিশ্চিত করা। আলোচনার প্রথমদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো সক্রিয়ভাবে জলবায়ু ন্যায়বিচার, অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধি, এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের বাস্তব কাঠামো নিয়ে তাদের জোরালো দাবি উত্থাপন করেছে। উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে আগের কপ-এ দেওয়া অর্থায়ন প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সম্মেলনের প্রথম দিনের বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে কপ ৩০ এজেন্ডা গৃহীত হয়। তবে কিছু সমর্থক দাবি করে যে, জলবায়ু অর্থায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আবারও অবহেলিত হতে পারে। উদ্বোধনী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে, টুভালুর জলবায়ু মন্ত্রী মাইনা ভাকাফুয়া তালিয়া বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যারিস চুক্তি প্রত্যাহার এবং জলবায়ু বিজ্ঞানের প্রতি ট্রাম্পের অস্বীকৃতি বিশ্বের বাকি অংশের প্রতি লজ্জাজনক ও অবজ্ঞাপূর্ণ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের জলবায়ু সচিব আয়েশা হুমেরা বলেন, জলবায়ু সংকট আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিশ্বের বৃহত্তম ও ঐতিহাসিক কার্বন নির্গমনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণ প্রথম দিনেই উল্লেখযোগ্যহারে অনুপস্থিত ছিল। এমনকি কোনও সরকারি কর্মকর্তা এবং মিডিয়া আউটলেটও উপস্থিত ছিল না। জাতিসংঘের ২৫ জন বিশেষ প্রতিনিধির একটি দল আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে পূর্ণ সম্মতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে, কারণ তাঁরা মনে করেন এর ব্যত্যয় জাতিসংঘ আয়োজিত সমগ্র কপ প্রক্রিয়ার উপর থেকে বিশ্ববাসীর বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।
এবারই প্রথম কপ-কে “ডেলিভারি–ফোকাসড কপ” বলা হচ্ছে, অর্থাৎ শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ ও সময়সীমা নির্ধারণ করাই সম্মেলনটির মূল লক্ষ্য। এখন পর্যন্ত সম্মেলনের আলোচনার ধারায় স্পষ্টত লক্ষণীয়, এই সম্মেলন জলবায়ু নীতি ও বৈশ্বিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে নতুন এক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ কাঠামোসহ লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ড সক্রিয় করার বিষয়টি কপ৩০-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্রাজিলের প্রবীণ জলবায়ু কূটনীতিক এবং কপ ৩০ সভাপতি আন্দ্রে কোরিয়া দো লাগো আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন, প্রতিশ্রুতি দেন যে, “বেলেম হবে সত্যের কপ"।
তিনি বলেন, কপ প্রক্রিয়া একটি পরিবর্তন আনছে, তবে আরো দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দরকার। ১০ বছর আগে প্যারিস চুক্তিটি সেই সময়ে ছিল যখন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে আমাদের তাপমাত্রা চার ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাবে এবং আজ আমরা জানি যে আমরা এটি হ্রাস করেছি। তবে আমরা এটাও জানি যে, এটি আরো কমাতে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তবে, এবছরের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের যুগান্তকারী জলবায়ু রায় অনুসারে, ২০২৩ সালে দুবাইতে অনুষ্ঠিত কপ ২৮-এ "জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন" বিষয়ে আলোচনা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি বাধ্যবাধকতামূলক এজেন্ডা হিসেবে বিবেচিত হলেও আনুষ্ঠানিক এজেন্ডার অধীনে রাখা কঠিন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অপরদিকে, গ্রীসের জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ অঞ্চল কর্ফু দ্বীপের পশ্চিমে আয়োনিয়ান সাগরে জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য অফশোর খননের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং এই খননকাজ ২০২৭ সালের প্রথম দিকে শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিল-এর গ্রীক শাখার পরিচালক দিমিত্রিস কারাভেলাস বলেন, বিশ্ব যখন ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে এবং বিজ্ঞান জীবাশ্ম জ্বালানির অবসান দাবি করছে, তখন গ্রীক সরকার পৃথিবীর নয়, বরং তেল ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জীববৈচিত্র্যের হটস্পট এবং গ্রীসের পর্যটন অর্থনীতির স্তম্ভ আয়োনিয়ানে খননের ব্যাপারে সম্মতি কেবল হতাশাজনক নয়, এটি অদূরদর্শী এবং সময়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ। রোববার গ্রীক প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোটাকিস বলেছেন যে, এই চুক্তি আগামী বছরগুলিতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করার মূল চাবিকাঠি হবে। মার্কিন জ্বালানি সচিব ক্রিস রাইট এই চুক্তিকে "ঐতিহাসিক" বলে অভিহিত করেছেন এবং গ্রীসকে মার্কিন মিত্র হিসেবে প্রশংসা করেছেন।
২০২১ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গবেষণা অনুসারে, সমুদ্রের পরে মাটিই বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন সিঙ্ক। তবে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র কার্বন সিঙ্ক হিসেবে মাটিকে ব্যবহারের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করছে। সোমবার প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৭০% দেশ তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি)-তে মাটিকে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের হাতিয়ার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে না। কৃষি মাটির দ্রুত অবক্ষয় মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী তৃণমূল আন্দোলন “সেভ সয়েল” দ্বারা পরিচালিত নতুন বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে যে, ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রাকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নির্গমন হ্রাসের ২৭% অর্জন করা যেতে পারে এবং কৃষি মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। মাটির স্বাস্থ্যকে পুনরুজ্জীবিত করে এমন টেকসই কৃষি পদ্ধতি ২০৫০ সালের মধ্যে সার-সম্পর্কিত নির্গমন ৮০% পর্যন্ত কমাতে পারে।
বাংলাদেশ সময় আজ রাতে কপ৩০-এর দ্বিতীয় দিনে এজেন্ডা অনুমোদনের পর মূল আলোচনার ধাপ শুরু হবে। এই দিনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধি, এবং গ্লোবাল স্টোকটেক (জিএসটি) বাস্তবায়নের রোডম্যাপ, যেখানে উন্নয়নশীল ও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো দৃঢ়ভাবে আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের দাবি তুলে ধরবে। বাংলাদেশও এই আলোচনায় গুরুত্বের সঙ্গে অংশ নেবে, কারণ দেশটির সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি মোকাবিলায় অভিযোজন তহবিল অপরিহার্য। সংযুক্ত আরব আমিরাত বার্ষিক সংলাপ আগামীকাল থেকে শুরু হবে।
দ্বিতীয় দিনে বিভিন্ন সাইড-ইভেন্টগুলোতে যুব প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার এবং পরিবেশসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো জলবায়ু ন্যায়বিচার, ক্ষতি–ক্ষতিপূরণ তহবিল এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষার ওপর জোর দিবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে সরকারি কর্মকর্তারা, বেসরকারি পরিবেশবাদী সংস্থার প্রতিনিধিরা এবং মিডিয়া প্রতিনিধিরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশের প্যভিলিয়নে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পরিকল্পনা করেছে। এছাড়াও বন সংরক্ষণ, নবায়নযোগ্য শক্তিতে দ্রুত রূপান্তর এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলোর ওপরও নতুন মাত্রায় আলোচনা করা হবে। সার্বিকভাবে আশা করা হচ্ছে, দ্বিতীয় দিন থেকেই কপ৩০-তে কাগজ-ভিত্তিক প্রতিশ্রুতি ছাড়িয়ে বাস্তবায়নমুখী সিদ্ধান্তের পথে এগোতে শুরু করবে, এবং এটি বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
