ভবিষ্যতের এক নীরব সংকট বেকারত্ব
সাইফুল ইসলাম শান্ত
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩২ পিএম
ভবিষ্যতের এক নীরব সংকট বেকারত্ব
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ডিজিটাল রূপান্তর সবই যেন এক নতুন আশার গল্প। কিন্তু এই উজ্জ্বল গল্পের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক গভীর অন্ধকার। যা ধীরে ধীরে আমাদের ভবিষ্যতের স্থিতি নষ্ট করে দিতে পারে। সেই অন্ধকারের নাম বেকারত্ব। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে যখন তরুণরা কর্মসংস্থানের আশায় পথে নামে, তখন বাস্তবতা তাদের স্বপ্নকে চূর্ণ করে দেয়। সরকারি চাকরিতে সীমিত সুযোগ, বেসরকারি খাতে অনিশ্চয়তা আর উদ্যোক্তা হওয়ার পথে নানা জটিলতা—সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক নীরব সংকট। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই তরুণ। এটি একদিকে যেমন বিশাল সম্ভাবনা, অন্যদিকে এক অনিয়ন্ত্রিত ঝুঁকিও। যদি এই তরুণ জনশক্তি উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত না হয়, তবে তারা পরিণত হবে সামাজিক অস্থিরতার কারণ, অর্থনীতির বোঝা, এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকিতেও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৭ লাখ মানুষ বেকার। গত বছরের যা ছিল ২৪ লাখ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে ৩ লাখের বেশি। শহরাঞ্চলে এই হার আরও বেশি। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ নতুন তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় না। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, যারা কর্মরত তাদের মধ্যেও বিপুল সংখ্যক আংশিক বেকার বা অপ্রতুল কর্মসংস্থানে নিযুক্ত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য বলছে—বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করার পরও অনেকেই মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর চাকরির অপেক্ষায় থাকেন। হতাশা, মানসিক চাপ, অপরাধ প্রবণতা ও অভিবাসনের অন্ধ আকাঙ্ক্ষা সবই এই বেকারত্বের ফলাফল হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
বেকারত্বের মূল কারণ-
বাংলাদেশে বেকারত্বের অন্যতম কারণ হলো শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের অমিল। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতি বছর লাখো শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করছে কিন্তু তাদের বড় অংশই শ্রমবাজারের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দক্ষতা অর্জন করছে না।
প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে যেখানে ডিজিটাল স্কিল, কারিগরি শিক্ষা ও উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োজন, সেখানে আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখনো মুখস্থনির্ভর জ্ঞান ও ডিগ্রির ওপর নির্ভর করছে। ফলাফল—শিক্ষিত অথচ কর্মহীন এক প্রজন্ম।
অন্যদিকে, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এখনো অনেক অভিভাবক পেশাগত বা টেকনিক্যাল শিক্ষাকে ‘নিম্নমানের’ মনে করেন। অথচ উন্নত দেশগুলোতে দক্ষ জনশক্তিই অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো শ্রমঘন খাতনির্ভর—যেমন তৈরি পোশাক, নির্মাণ ও কৃষি। এসব খাতে কর্মসংস্থান আছে কিন্তু অধিকাংশই নিম্ন বেতন ও কম নিরাপত্তার চাকরি। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত প্রযুক্তিনির্ভর কাজের সুযোগ সীমিত।
অন্যদিকে, শিল্পায়নের গতি কাঙ্ক্ষিত নয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাত (এসএমই)–এর বিকাশ হলেও তা যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না। বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগও প্রত্যাশার তুলনায় কম। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে।
প্রতি বছর প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ বাংলাদেশি কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির একটি বড় ভিত্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই অভিবাসন কি প্রকৃত সমাধান? বিদেশগামী শ্রমিকদের বড় অংশই অদক্ষ বা অল্প দক্ষ। ফলে তারা স্বল্পবেতনের কাজেই সীমাবদ্ধ থাকছেন। আবার মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার মতো শ্রমবাজারগুলোতে অস্থিরতা দেখা দিলে দেশে ফিরে আসেন হাজার হাজার কর্মী, যাদের পুনর্বাসন কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, বিদেশে শ্রম রপ্তানি সাময়িক স্বস্তি দিলেও এটি কোনো দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান নীতি নয়।
বেকারত্বের সামাজিক প্রভাব-
দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্ব হতাশা, মানসিক অস্থিরতা ও মাদকাসক্তি বাড়ায়। অনেক তরুণ অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের দিকে ঝুঁকছেন—সাইবার অপরাধ, অনলাইন প্রতারণা কিংবা চরমপন্থার দিকেও যাচ্ছে অনেকে।
অন্যদিকে, বেকারত্ব রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতারও কারণ হতে পারে। বঞ্চিত তরুণরা সহজেই উগ্র রাজনীতির বা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার অংশ হয়ে পড়েন। ফলে বেকারত্ব কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবেও বিবেচ্য।
কীভাবে মোকাবেলা করা যায়-
এই সংকট মোকাবেলায় দরকার রাষ্ট্রীয় নীতি, শিক্ষা সংস্কার ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগ। শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘ইন্ডাস্ট্রি-লিঙ্কড’ পাঠ্যক্রম চালু করা জরুরি, যাতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব দক্ষতা অর্জন করতে পারে। কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করতে হবে এবং নারী শিক্ষার্থীদেরও এই খাতে যুক্ত করতে হবে।
সবাই চাকরি খুঁজবে এই ধারণা থেকে বের হতে হবে। তরুণদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ দিতে হবে। ক্ষুদ্র ঋণ, স্টার্টআপ তহবিল, ইনোভেশন ল্যাব—এসব গড়ে তুলতে হবে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতায়।
বিদেশি ও দেশীয় বিনিয়োগ আকর্ষণে করনীতি সরল করতে হবে। নতুন শিল্পাঞ্চল, আইটি পার্ক ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে তরুণদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আইটি, ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স, গেম ডেভেলপমেন্ট ও সাইবার সিকিউরিটির মতো খাতে তরুণদের জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশকে ‘ইনোভেটিভ বাংলাদেশ’-এ পরিণত হতে হবে।
যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের জন্য আধুনিক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, যাতে তারা উচ্চমূল্যের কাজের সুযোগ পান।
নারীরা এখনো কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব পাচ্ছেন না। নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সমান বেতনের নিশ্চয়তা দিয়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে।
সরকারের ভূমিকা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা-
সরকার ইতিমধ্যে ‘জাতীয় কর্মসংস্থান নীতি ২০২২’ ঘোষণা করেছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে বাস্তবায়নই আসল চ্যালেঞ্জ। নীতিমালা কাগজে নয়, বাস্তবে ফল দিতে হবে।
অন্যদিকে, স্থানীয় সরকার স্তরেও যুব উন্নয়নকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ ও কর্মমেলা আয়োজনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় প্রকল্পগুলিতে তরুণদের সম্পৃক্ততা বাড়ালে তারা শুধু কর্মসংস্থানের সুযোগই পাবে না, জাতীয় উন্নয়নের অংশীদারও হবে।
যুব সমাজ একটি দেশের প্রাণশক্তি কিন্তু এই ইঞ্জিন যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে উন্নয়নের পুরো যাত্রাই থেমে যাবে। আজকের বেকার তরুণ মানে আগামী দিনের অর্থনৈতিক চাপ ও সামাজিক অস্থিরতা। বাংলাদেশের তরুণরা এই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি, আবার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাও হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা এখনই সঠিক পথে এগোতে না পারি। বেকারত্ব কেবল অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি এক নীরব সামাজিক আগ্নেয়গিরি। যা বিস্ফোরিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজ, অর্থনীতি, এমনকি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতাও। যুব সমাজকে কর্মমুখী দক্ষতায় গড়ে তোলা, প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা এসবই হতে পারে বাস্তব সমাধানের পথ। আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রথমে কর্মসংস্থানমুখী বাংলাদেশ গড়তে হবে।
আমাদের এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি এক ‘শিক্ষিত কিন্তু কর্মহীন’ প্রজন্ম গড়বো। নাকি এমন একটি প্রজন্ম গড়বো, যারা উদ্ভাবনে, উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ও উৎপাদনে নেতৃত্ব দেবে? রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু কাজ তৈরি করা নয়, তরুণদের কাজের যোগ্য করে তোলা। সমাজের দায়িত্ব তাদের সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেওয়া। আর তরুণদের দায়িত্ব নিজেদের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা। আজ যদি আমরা যৌথভাবে এই সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে পারি, তবে বেকারত্ব আমাদের দুর্বলতা নয়—আমাদের পরবর্তী সাফল্যের ভিত্তি হয়ে উঠবে।
