বেশির ভাগই বাংলাদেশ–ভারত–পাকিস্তানের
ব্রিটিশ নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে এক কোটি মুসলিম
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৩৫ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাজ্য সরকারের ‘চরম ও গোপনীয়’ নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষমতার কারণে দেশটির প্রায় এক কোটি মুসলিম ব্রিটিশ নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে এক নতুন প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা এই জনগোষ্ঠীর বড় অংশই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত।
নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংস্থা রানীমীড ট্রাস্ট এবং আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের সংগঠন রিপ্রিভের যৌথভাবে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে থাকা এই ক্ষমতার আওতায় যুক্তরাজ্যের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ—যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৩ শতাংশ—তাদের নাগরিকত্ব হারাতে পারেন। খবর মিডল ইস্ট আইয়ের।
প্রতিবেদনটি সতর্ক করে বলছে, নাগরিকত্ব বাতিলের এই ক্ষমতা দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নাগরিকদের ওপর ‘অসমভাবে প্রভাব ফেলছে’ এবং বিশেষভাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। উভয় সংস্থার মতে, এই ব্যবস্থা এখন যুক্তরাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য একটি পদ্ধতিগত হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান আইনে, সরকার যদি মনে করে কোনো ব্রিটিশ নাগরিক অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য, তাহলে তিনি তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব হারাতে পারেন। এমনকি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সেই দেশে কখনো বসবাস না করলেও বা সেই নাগরিকত্ব গ্রহণ না করলেও এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ঐতিহ্যগত বা পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে—এমন ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
প্রতিবেদনটি আরো বলছে, এই ব্যবস্থা নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে এক ধরনের জাতিগত শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করেছে। এতে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের তুলনায় মুসলিমদের নাগরিকত্ব শর্তহীন নয়, বরং শর্তসাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। রিপ্রিভের কর্মকর্তা মায়া ফোয়া বলেন, ‘বিগত সরকার রাজনৈতিক লাভের জন্য বিদেশে থাকা ব্রিটিশদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে, আর বর্তমান সরকার এই চরম ও গোপনীয় ক্ষমতাগুলো আরো বিস্তৃত করেছে।’
আরো পড়ুন : যুক্তরাজ্যে স্থায়ী হতে শরণার্থীদের অপেক্ষা করতে হবে ২০ বছর
তিনি বলেন, ‘যে ৯০ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেড়ে নিতে পারেন, তাদের জন্য পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।’
রানীমীড ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী শাবানা বেগমও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আওতাধীন ক্ষমতায় ‘নাগরিকত্ব বাতিলের একটি শীতল স্রোত’ বইছে, যা যুক্তরাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর অসমভাবে প্রভাব ফেলছে। তার ভাষায়, ‘যে আইন একসময় বড় কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়েছিল, ঠিক তেমনি এই ক্ষমতাগুলো অপব্যবহার রোধে কার্যকর কোনো সুরক্ষা নেই।’
শাবানা বেগম বলেন, ‘নাগরিকত্ব একটি মৌলিক অধিকার, কোনো বিশেষ সুযোগ নয়। অথচ ব্রিটেনের সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে দুই-স্তরীয় ব্যবস্থা চালু করছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি বিপজ্জনক নজির।’
এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
রিপ্রিভ ও রানীমীডের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন অশ্বেতাঙ্গ মানুষের মধ্যে তিনজন নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিপরীতে, শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের মধ্যে প্রতি ২০ জনে মাত্র একজন একই ঝুঁকির মুখে পড়ছেন।
ঝুঁকিতে থাকা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৯ লাখ ৮৪ হাজার, পাকিস্তানি ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত ৬ লাখ ৭৯ হাজার এবং এশীয় ব্রিটিশদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি রয়েছেন।
প্রতিবেদনটি আরো জানায়, যাদের নাগরিকত্ব বাস্তবে বাতিল করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত মুসলিম। এতে উল্লেখ করা হয়, অশ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশরা তাদের শ্বেতাঙ্গ সহনাগরিকদের তুলনায় নাগরিকত্ব হারানোর ক্ষেত্রে ১২ গুণ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে, নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষমতা—যা একসময় কেবল ব্যতিক্রমী যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ হতো—গত দুই দশকে সন্ত্রাস দমন আইনগুলোর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে ‘জনসাধারণের মঙ্গল’ দেখিয়ে ২০০ জনের বেশি মানুষের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, যাদের বড় অংশই মুসলিম। ২০২২ সালে সরকার কোনো ব্যক্তিকে না জানিয়েই তার নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষমতা লাভ করে।
এ ছাড়া ২০২৫ সালের একটি আইন নিশ্চিত করেছে যে, আদালত নাগরিকত্ব বাতিলকে বেআইনি ঘোষণা করলেও সরকারের আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত—যা অনেক সময় বছরখানেক স্থায়ী হতে পারে—ভুক্তভোগীরা তাদের নাগরিকত্ব ফিরে পাবেন না।
