×

রাজধানী

সেবা কেন্দ্রীকরণ

রাজউক হাঁটছে উল্টোপথে

Icon

মুহাম্মদ রুহুল আমিন

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০১:৪৯ পিএম

রাজউক হাঁটছে উল্টোপথে

ছবি : সংগৃহীত

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগর উন্নয়ন সংস্থা। নাগরিকসেবা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সংস্থাটি গত এক দশকে যে কাঠামো তৈরি করেছিল, সেটি এখন ভেঙে দিতে যাচ্ছে রাজউক নিজেই। সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজধানীর চারটি জোন অফিস (জোন-৪, ৫, ৬ ও ৭) বন্ধ করে সেগুলোকে রাজউকের মতিঝিলের প্রধান কার্যালয় ও মহাখালী অফিসে স্থানান্তর করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ‘স্পেস বরাদ্দ কমিটি’কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজউক ভবনে এক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় উত্থাপিত অভ্যন্তরীণ নথি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় জোন-৪ অফিসকে রাজউকের গাড়ি পার্কিং ভবন এবং জোন-৫ অফিসকে ইউআরপি (টজচ) ভবনে স্থানান্তরের প্রস্তাব করা হয়। এরপর জুলাই ২০২৫ সালের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, জোন-৫, ৬ ও ৭ অফিস রাজউকের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তর করা হবে। তবে ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত স্পেস বরাদ্দ কমিটির সভায় চেয়ারম্যানের নির্দেশে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হয় এবং পরে তিনি আবারো আলোচনাসভা আহ্বানের আগ্রহ প্রকাশ করেন।

রাজউকের যুক্তি- সব অফিস এক জায়গায় থাকলে সমন্বয় সহজ হবে, সিদ্ধান্ত নেয়া দ্রুত হবে এবং প্রশাসনিক জটিলতা কমবে। কিন্তু রাজউকের ভেতর থেকেই অনেক কর্মকর্তা এই সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থাটির একজন পরিচালক ভোরের কাগজকে বলেন, জোন অফিসগুলো করার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষ যেন নিজের এলাকার অফিসে সেবা নিতে পারে। এখন সেই সুবিধা তুলে নেয়া হচ্ছে। এতে মানুষ আবার মতিঝিল-মহাখালীর যানজটে পড়ে ভোগান্তিতে পড়বে, আর ফাইলের জট ও দালালদের দৌরাত্ম্য আবারো বাড়বে। 

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, অনলাইন সেবা এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি, আইটি ইন্টিগ্রেশন অসম্পূর্ণ। এই অবস্থায় সব জোন বন্ধ করলে মানুষকে আবার হাতে ফাইল নিয়ে রাজউকের সদর দপ্তরের বারান্দায় ঘুরতে হবে। এতে প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, নাগরিক দুর্ভোগই বাড়বে।

২০১৩ সালে রাজউক ঢাকার সেবা কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনে। রাজধানীকে চারটি বড় জোনে ভাগ করে প্রতিটি জোনকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করা হয়; এখন যার সংখ্যা ৮টি জোন ও ২৪টি উপজোন। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল রাজউকের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া, যাতে মতিঝিলের প্রধান কার্যালয়ে না গিয়েও মানুষ স্থানীয় অফিস থেকে বিল্ডিং পারমিট, নকশা অনুমোদন, জমির দলিল যাচাই বা ফি জমা দিতে পারে।

এর আগে কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সাভার বা নারায়নগঞ্জের ডিএনডি এলাকার মানুষকে এসব কাজের জন্য মতিঝিল আসতে হতো। এতে সময় ও অর্থের অপচয় হতো আর যানজটের ভোগান্তিতো আছেই। ফলে অনেকে অনুমোদন না নিয়েই ভবন তৈরি করতেন- যা ‘ডেবিটেড বিল্ডিং’ নামে পরিচিত। বিকেন্দ্রীকরণ কার্যকর হওয়ার পর এসব এলাকায় মানুষ ভবন নির্মাণে নকশা অনুমোদনের বিষয়ে আগ্রহী হয়। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও ইঞ্জিনিয়াররা স্থানীয় বাস্তবতা জেনে দ্রুত অনুমোদন দিতেন, ফলে অনিয়মও কমে যায়। কিন্তু এখন সেই কাঠামো ভেঙে রাজউক আবার কেন্দ্রীকরণের পথে হাঁটছে।

রাজউকের ওই পরিচালক বলেন, আমরা কয়েক বছরে দেখেছি- বিকেন্দ্রীকরণের পর মানুষ রাজউকের ওপর আস্থা পেয়েছিল। স্থানীয় অফিসে গিয়ে কাজ করা সহজ হয়েছিল। এখন সব অফিস বন্ধ হলে মানুষ আবার রাজউক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। ফলে অননুমোদিত ভবন তৈরির আশঙ্কা বাড়বে।

রাজউকের একজন পরিদর্শক বা ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব থাকে বিল্ডিং মনিটর করা, অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ হচ্ছে কিনা তা দেখা। এ কাজের জন্য নিয়মিত মাঠে যেতে হয়- কখনো কেরানীগঞ্জে, কখনো সাভারে, কখনো রূপগঞ্জে কখনো বা নারায়নগঞ্জের ডিএনডি এলকায়। এখন যদি তাদের অফিস হয় মতিঝিল বা মহাখালীতে, তবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেই তিন ঘণ্টা লেগে যাবে।

ওই পরিচালক আরো বলেন, রাজউক ইমারত পরিদর্শকদের যাতায়াতের জন্য কোনো যানবাহন দেয় না। নিজের পকেট থেকে খরচ করে মাঠে যেতে হয়। ফলে অনেকে মাঠে যেতে আগ্রহী হবে না। কেউ কেউ ভবন মালিকের কাছ থেকে যাতায়াত খরচ তুলে নিতে পারে, এতে দুর্নীতি বাড়বে। তিনি আরো বলেন, দিন শেষে দেখা যাবে- কাগজে আমরা মনিটর করছি, কিন্তু মাঠে যাচ্ছি না। এতে অননুমোদিত ভবন বেড়ে যাবে। রাজউক তখন দায় নেবে, কিন্তু নাগরিকসেবা আর থাকবে না।

রাজউকের জনবল ২০১৩ সালে ছিল ৭৯৪ জন। পরে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া কার্যকর করতে সেটি বাড়িয়ে ১ হাজার ৯৪৮ জনে উন্নীত করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বেশির ভাগ পদ খালি। নতুন লোক নিয়োগ না দিয়েই আবার সব অফিস এক জায়গায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওই পরিচালক আরো বলেন, যখন মাঠে লোক নেই, তখন সেবা তো বন্ধ হবেই। বরং এখন জোনভিত্তিক অফিসগুলোকে শক্তিশালী করা উচিত ছিল। সরকার যে বাড়তি জনবল দিয়েছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা যেত।

মতিঝিল ও মহাখালী ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত অফিস অঞ্চল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই দুই এলাকার রাস্তাগুলো প্রায় থমকে থাকে যানজটে। এখন যদি রাজউকের চারটি জোনের মানুষ সেখানে আসা-যাওয়া শুরু করে, তবে শহরের চাপ আরো বাড়বে। সাভারের বাসিন্দা মো. জামালউদ্দিন বলেন, আগে রাজউকের জোন অফিসে খুব তাড়াতাড়ি যেতাম। এখন যদি মতিঝিলে কিংবা মহাখালীতে যেতে হয়, তাহলে একাধিক বাস বদলাতে হবে। যাওয়া-আসাতেই অর্ধেক দিন শেষ হয়ে যাবে। রূপগঞ্জের বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, শুনেছি, রাজউকের জোন অফিস প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এতে তো আমাদের মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তে হবে। প্রতিবার শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে আমরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলব রাজউকের সেবা নিতে। কারণ সারাদিন লেগে যাবে যাওয়া-আসায়। তাই রাজউক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, তারা যেন এককেন্দ্রীকরণ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

এ বিষয়ে বিআইপির সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়াই যে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব। এতে নাগরিকদের সময় বাঁচে, কষ্টও কমে। রাজউক যদি সত্যিকারের কার্যকর ও জনবান্ধব হতে চায়, তাহলে জোনভিত্তিক অফিসগুলো চালু রাখা দরকার। এতে সেবা বিকেন্দ্রীকরণ হয়- অর্থাৎ মানুষ নিজের এলাকার অফিসেই কাক্সিক্ষত সেবাটা নিতে পারবে। এতে শুধু মানুষের সুবিধা হয় না, রাজউকের কাজও দ্রুত ও ফলপ্রসূ হয়। কিন্তু এখন রাজউক উল্টো পথে হাঁটছে। সব অফিস এক জায়গায় এনে আবার কেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে- যা পুরোপুরি গণবিরোধী সিদ্ধান্ত। এতে নাগরিকদের সেবা পাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়বে, ভোগান্তি বাড়বে। কাজেই আমরা রাজউককে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

এই নগরবিদ আরো বলেন, পরিকল্পনা ও নগর ব্যবস্থাপনায় বিকেন্দ্রীকরণই মূল নীতি। রাজউক সেই নীতির বিপরীতে যাচ্ছে। এখনই এই প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে বিকেন্দ্রীকৃত সেবা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করা উচিত।

প্রধান ভবনে আনা হচ্ছে উত্তরা এস্টেট শাখার নথি : রাজউকের কেন্দ্রীকরণের ধারাবাহিকতায় উত্তরার জোনাল অফিস থেকেও গুরুত্বপূর্ণ নথি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, উত্তরায় অবস্থিত রাজউক জোনাল অফিসে সংরক্ষিত উপপরিচালক (এস্টেট ও ভূমি-২) শাখার সব নথি রাজউকের মতিঝিলের প্রধান ভবনে আনার বিষয়ে সম্প্রতি আলোচনা হয়েছে। সভায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওই শাখার সব নথি আবশ্যিকভাবে প্রধান ভবনে স্থানান্তর করতে হবে। রাজউকের মতে, এটি প্রশাসনিক ও সংরক্ষণ সুবিধার জন্য নেয়া হয়েছে। তবে অনেক কর্মকর্তা মনে করছেন, এটি কেন্দ্রীকরণেরই অংশ, যার ফলে স্থানীয় অফিসের কার্যক্রম দুর্বল হবে।

রাজউক উত্তরা জোনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, এখন আমাদের অফিসে অনেকেই জমি-সংক্রান্ত সেবা নিতে আসেন। কিন্তু নথি চলে গেলে তাদের আবার মতিঝিলে যেতে হবে। এতে সেবা দিতে সময় বাড়বে, খরচও বাড়বে। তিনি আরো বলেন, যে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে রাজউক একসময় মানুষের কাছে গেছে, এখন সেই পথ থেকে সরে এসে রাজউক আবার নাগরিককে নিজের কাছে টানছে। এতে প্রশাসনিক দক্ষতা নয়, বরং জনদুর্ভোগই বাড়বে।


সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

টেকনাফে ব্রিজের নিচে মিলল বিএনপি নেতার মরদেহ

টেকনাফে ব্রিজের নিচে মিলল বিএনপি নেতার মরদেহ

নির্বাচন হলে দেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে : সেনাসদর

নির্বাচন হলে দেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে : সেনাসদর

এনসিপি কিভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে, জানালেন নাহিদ ইসলাম

এনসিপি কিভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে, জানালেন নাহিদ ইসলাম

নির্বাচনে অংশ নেবেন অ্যাটর্নি জেনারেল

নির্বাচনে অংশ নেবেন অ্যাটর্নি জেনারেল

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App