ছোট বোনের চেয়েও বয়স কম!
মুকুল মিয়ার জাল সনদে সরকারি চাকরিতে যোগদান
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:১০ পিএম
সাবেক আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ফারুক খানের সঙ্গে পিয়ন মুকুল মিয়া। পাশে মুকুলের বাউন্ডারিসমৃদ্ধ আলিশান অট্টালিকা। ছবি: সংগৃহীত
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মহা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মুকুল মিয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতা, নাম, জন্মতারিখ জালিয়াতি করে সরকারি চাকরিতে যোগদান এবং পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, মুকুলের আপন ছোট বোন রহিমা আক্তারের চেয়েও তার বয়স পাঁচ বছর কম দেখানো হয়েছে জাল সনদে। এই দুর্নীতির সঙ্গে তার বড় ভাই স্বপন মিয়া, বড় বোন যুগ্ম সচিব রোকেয়া বেগম এবং ভগ্নিপতি শামীম ফকিরের সক্রিয় জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় জনগণ এই জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠিন বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরিতে প্রবেশ:
ভোরের কাগজের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, মুকুল মিয়া ১৯৯৪ সালে বাটিকামারী স্কুল থেকে ‘গোলাম শাহাদাত কবির মিয়া’ নামে এসএসসি পাশ করেন। তখন তার জন্ম তারিখ ছিল ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮। এই তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে তার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা শেষ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুকুল মিয়া বাহাড়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণি পাসের একটি ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরি করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তিনি কখনই মাদ্রাসায় পড়েন নাই। এই প্রক্রিয়ায় তিনি তার পূর্বের নাম গোলাম শাহাদাত কবির মিয়া পরিবর্তন করে শুধুমাত্র ‘মুকুল মিয়া’ ধারণ করেন এবং জন্ম তারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ এর পরিবর্তে ১ মার্চ ১৯৮৬ করেন, যা তার বয়স আট বছর কমিয়ে দেয়। এই জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি সরকারি চাকরির বয়সসীমা অতিক্রম করার পরেও চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পান।
ভোটার আইডি কার্ডে জালিয়াতির প্রমাণ:
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মুকুল মিয়া এরপর ভোটার তালিকা থেকে অবৈধভাবে তার পূর্বের নাম শাহাদাত কবির মিয়া বাতিল করে মুকুল মিয়া নাম অন্তর্ভুক্ত করেন (জাতীয় পরিচয়পত্র নং-৩৫০৭৯৬৮০৮৫৬৪)। জাতীয় পরিচয়পত্র বিশ্লেষণ করে ভয়ংকর জালিয়াতি দেখা গেছে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী মুকুল মিয়ার জন্ম তারিখ ১ মার্চ ১৯৮৬ এবং তার ছোট বোন রহিমা আক্তারের (জাতীয় পরিচয়পত্র নং-৩৫০৭৯৬৮০৮৫৪৬) জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি ১৯৮১। অর্থাৎ মুকুলের ছোট বোনের চেয়ে বড় ভাই মুকুল মিয়ার বয়স পাঁচ বছর কম! এই পুরো জালিয়াতি প্রক্রিয়ায় তার বড় ভাই স্বপন মিয়া, বড় বোন রোকেয়া বেগম (যিনি বর্তমানে যুগ্ম সচিব) এবং ভগ্নিপতি শামীম ফকির সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও প্রভাব বিস্তার:
মুকুল মিয়া পিয়ন পদে চাকরিতে যোগদানের পূর্বে তার আর্থিক অবস্থা সাধারণ পরিবারের মতোই ছিল। কিন্তু চাকরি জীবনে প্রবেশের পর তিনি তার বড় বোনের মাধ্যমে অনেক লোকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে চাকরি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই ঘুষের টাকা ব্যবহার করে তিনি পুকুর ভরাট করে বিশাল বাউন্ডারিসমৃদ্ধ অট্টালিকা ও গুদাম ঘর নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও, বাজারে কয়েকটি পাকা দোকান ঘর তৈরি, সুদে টাকা খাটানো, জমি কেনা ও বন্ধক রাখাসহ বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকা সাদা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৬ বছরে মুকুল মিয়া, তার ভগ্নিপতি শামীম ফকির, শ্বশুর সোলেমান চৌধুরী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে। এছাড়াও, তারা বিভিন্ন স্থানে ভূমি ক্রয় করে ভবন নির্মাণ করে বিত্তশালী হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ভাই ও বোনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ:
মুকুল মিয়ার বড় ভাই স্বপন মিয়ার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে। তিনি ৯০ দশকে ভাঙা কলেজের ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক এবং বাটিকামারী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছর সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। অভিযোগ অনুযায়ী, স্বপন মিয়া এলাকায় এখনও তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করছেন। আওয়ামীলীগ ক্ষমতা হারানোর পর যেখানে তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা হবার কথা সেখানে সেই খোলস পাল্টিয়ে টাকা খরচ করে নিজেকে আড়াল রেখেছে এবং পূর্বের গ্রুপিং প্রতিহিংসার প্রতিশোধ নিতে, ইউনিয়ন সভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদ এবং ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি সবো সরদার, শহীদ সর্দারকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ তার সমর্থকদের দিয়ে মারধর করে গুরুতর জখম করেছে মর্মে অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জানা যায়, দুই বছর পূর্বে মঞ্জুর মোর্শেদ স্বপন মিয়ার দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত বাহাড়া মাদ্রাসায় গিয়ে মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ এবং কয়েক বিঘা জমির আয়-ব্যয় জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানান। এর প্রতিক্রিয়ায় স্বপন মিয়া তার বোন রোকেয়ার মাধ্যমে ইউএনও এবং থানা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে গ্রামে তার প্রভাব অক্ষুণ্ণ রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মুকুল মিয়ার বড় বোন রোকেয়া বেগম ১৭ বছর ধরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন এবং বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিশাখার যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্বরত। অভিযোগ উঠেছে, রোকেয়া বেগম নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। তিনি অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দিয়েছেন এবং কিছু লোকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার পরও চাকরি দিতে পারেননি।
জনগণের ক্ষোভ ও বিচার দাবি:
স্থানীয় গ্রামবাসী এবং জনগণ মুকুল মিয়া, স্বপন মিয়া এবং শামীম ফকির এই তিনজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বলে দাবি করেছেন। তারা এই দুর্নীতিবাজ চক্র এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠিন বিচার দাবি করেছেন। এলাকাবাসীর মতে, এদের সঠিক বিচার না হলে শান্তিপ্রিয় জনগণের এলাকায় বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে।
দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ:
গোপালগঞ্জের মুকসেদপুর বাহাড়া খন্দকার পাড়ার মো. মহিউদ্দিন খন্দকার নামের একজন ব্যক্তি মুকুল মিয়া, স্বপন মিয়া, রোকেয়া বেগম এবং শামীম ফকিরের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিস্তারিত উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রধান কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগে তিনি এই সকল দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে দ্রুত ও সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছেন। অভিযোগকারী আরও জানান, এর আগে চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল একই বিষয়ে অভিযোগ করা হলেও জয়েন্ট সেক্রেটারি রোকেয়া বেগমের প্রভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক বিজন কুমার রায় অভিযোগটি ধামাচাপা দিয়েছেন বলে গোপন সুত্রে জানা যায়। গত বছর ১৩ আগস্ট সুন্দরবন কুরিয়ারের মাধ্যমে বিজন কুমার রায় একটি অভিযোগ গ্রহণ করেন এমন প্রমাণ ভোরের কাগজের হাতে রয়েছে।
অভিযোগ বিষয়ে মুকুলের বক্তব্য:
গোলাম শাহাদাত কবির মিয়া ওরফে মুকুল মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন জাল জালিয়াতির অভিযোগের বিষয়ে গত ২৭ নভেম্বর যোগাযোগ করা হলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি দাবি করেন, ছোট বোনের তুলনায় বয়স কম দেখিয়ে সার্টিফিকেট তৈরি করা বা জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কম থাকার অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। তিনি আরও বলেন, এলাকার কিছু মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। তিনি নিজে কোনো ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত নন এবং তার কাছে এ সংক্রান্ত সব বৈধ কাগজপত্র রয়েছে বলেও দাবি করেন। তবে মুকুল ও তার ছোট বোনের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি চাওয়া হলে তিনি গ্রামে অবস্থান করছেন এবং ঢাকায় ফিরে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টস দেখাবেন বলে প্রতিবেদককে জানান। এরপর কাগজপত্র পর্যালোচনার জন্য একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি এবং সংশ্লিষ্ট কোনো নথিপত্রও দেখাতে পারেননি।
