সবার দৃষ্টি আজ ট্রাইব্যুনালে
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায়
হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৮ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা হবে আজ সোমবার। অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ (আইসিটি) রায় ঘোষণা করবেন। আদালতের অনুমতি নিয়ে রায় ঘোষণার নির্দিষ্ট অংশ বিটিভি সরাসরি সম্প্রচার করবে বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউশন।
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অভিযোগে বহুল আলোচিত এই মামলায় পাঁচটি অভিযোগ এনে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন। অন্যদিকে, আসামিদের নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়েছেন তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী। এছাড়া রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের খালাস চেয়েছেন তার আইনজীবী।
গত ১৩ নভেম্বর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণার জন্য ১৭ নভেম্বর দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত ২৩ অক্টোবর অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামানের সমাপনী বক্তব্য শেষে ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন।
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলার কী রায় ঘোষণা হতে পারে- তা নিয়ে উৎসুক রাজনৈতিক মহলসহ দেশের মানুষ। তাদের দৃষ্টি এখন ট্রাইব্যুনালের দিকে। একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে গত কয়েক দিন ধরে। এই রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন পালন করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। আদালত এলাকাসহ সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সারাদেশে নিরাপত্তায় আইনশঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নিয়োজিত করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে যে রায় হোক, তা কার্যকর হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জুলাই আন্দোলনের সময় প্রাণঘাতী দমনপীড়নের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, তার অনুপস্থিতিতে যে বিচার চলছে, তা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নিয়ন্ত্রিত ‘ক্যাঙ্গারু কোর্টের’ সাজানো এক ‘প্রহসন’। তার দাবি, এই বিচার শুরু থেকেই ‘পূর্বনির্ধারিত দোষী সাব্যস্ত রায়ের’ দিকে এগোচ্ছিল।
সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে প্রসিকিউশন, রায় ঘোষণা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার : গতকাল রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, রায়ের যে অংশটুকু ট্রাইব্যুনাল পড়ে শোনাবেন, সে অংশটুকু ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং তাদের মাধ্যমে দেশের অন্য সব গণমাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একযোগে ‘রায় ঘোষণা’ সম্প্রচার করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তামিম বলেন, সাধারণ আইনে জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে নারী, অসুস্থ ও কিশোরদের কিছুটা অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। তবে রায়ের ক্ষেত্রে সাধারণ আইনেও তেমন কিছু নেই, এই আইনেও নেই। অপরাধ প্রমাণ হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে নারী হিসেবে শেখ হাসিনার বিশেষ সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, রায়ের ক্ষেত্রে আসামি নারী হোক, পুরুষ হোক- তিনি তার অবস্থানে থেকে কী অপরাধ করেছেন, সেই অপরাধের তীব্রতা বিবেচনা করে শাস্তি দেয়া হবে। মামলা প্রমাণ না হলে খালাস দেয়া হবে।
আদালত রায়ের তারিখ ঠিক করে দেয়ার পর গত ১৩ নভেম্বর চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করেছি। আদালত তার সুবিবেচনা প্রয়োগ করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। তবে আমরা চাই, এ অপরাধের দায়ে আসামিদের যেন সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হয়।
তিনি বলেন, আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, যারাই বাংলাদেশে, যত শক্তিশালী হোক না কেন, যদি কেউ অপরাধ করে, মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তাদের সঠিক পন্থায় বিচারের মুখোমুখি করা হবে। এখন ১৭ নভেম্বর আদালত তার সুবিবেচনা, তার প্রজ্ঞা প্রয়োগ করবেন এবং এই জাতির যে বিচারের জন্য আকাক্সক্ষা, যে তৃষ্ণা, সেটার প্রতি তারা সুবিচার করবেন, একটি সঠিক রায়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে ভবিষ্যতের জন্য এই রায়টি ইনশাআল্লাহ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, তেমন একটি রায়ই আমরা প্রত্যাশা করছি।
মামলা-অভিযোগ : বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২০২৪ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধ আন্দোন কর্মসূচি পালন করে। পরে তা জুলাই-আগস্টে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে ওই বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতন ঘটে। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলা হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। মামলায় আন্দোলনে ১৪শ মানুষকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয় গত বছরের ১৭ অক্টোবর। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছরের ১৬ মার্চ সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে এ মামলায় আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন। পরে ট্রাইব্যুনাল তাতে সম্মতি দেন। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা চলতি বছরের ১২ মে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। আর প্রসিকিউশন শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে গত ১ জুন। সেখানে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। সেগুলো হলো- গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার ‘উসকানিমূলক বক্তব্য’ দেয়া; হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেয়া; রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় ছয় আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনকে পোড়ানোর অভিযোগ। এই পাঁচ অভিযোগে গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলার বিচার শুরু হয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য এই আদালত গঠন করেছিল শেখ হাসিনার সরকার।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও ভারতে আছেন বলে ধারণা করা হয়। তাদের পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচারকাজ চলে। কারাগারে থাকা একমাত্র আসামি সাবেক আইজিপি মামুন ১০ জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদÐ চান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। অন্যদিকে আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন দুই আসামির খালাসের আর্জি জানান। রাজসাক্ষী মামুনের পক্ষেও খালাসের আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
এ মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান সেদিন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে ইঙ্গিত করে বলেন, যদি এই আসামিদের মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে অনেকেই প্রতিবাদ করবেন। এই দুইজনের যদি বিচার না হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ভীরু-কাপুরুষ হয়ে উপহাসের পাত্র হয়ে থাকবে। আমি আশা করি, আসামিরা এই বিচারের রায় মেনে নেবেন; অন্য কোনো পথ বেছে নেবেন না। আমি আশা করি, এই আদালত সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করবে।
এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন অভ্যুত্থানে নিহত আবু সাঈদের পিতাসহ স্বজনহারা পরিবারের অনেকে। এছাড়া স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্য়বাক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। সর্বমোট ৫৪ জন সাক্ষী এই মামলায় সাক্ষ্য দেন।
মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস এইচ তামিম শুনানি করেন। এছাড়া প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ, শাইখ মাহদি, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যান্য প্রসিকিউটর।
অন্যদিকে, আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আর রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।
বিচারের দাবি ও কর্মসূচি : জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার শেষ করার দাবি জানিয়ে আসছে। এ মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি পালন করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে শুক্র ও শনিবার বিক্ষোভ কর্মসূচি এবং রবিবার ও আজ সোমবার শাটডাউন কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। তাদের ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে গত কয়েক দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত বোমাবাজি এবং যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
