তোপের মুখে উপদেষ্টারা

হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০৩ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
জাতীয় নির্বাচনের দিকে দেশ যত এগিয়ে যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে সরকারসমর্থক রাজনৈতিক দলগুলো। দল অনুগতদের দিয়ে প্রশাসন সাজানোর পরস্পর অভিযোগ করে আসছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। আর এতে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টা বিশেষ ভূমিকা রাখছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এবার আরো এক ধাপ এগিয়ে জামায়াত দাবি করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কোন কোন উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদরে নাম ও কণ্ঠ রেকর্ড আছে। নীলনকশার নির্বাচনের ষড়যন্ত্র চলছে। সংশোধন না হলে তাদের নাম জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি করা হয়।
এর আগে উপদেষ্টাদের নির্বাচনীসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক তুলে সরকারঘনিষ্ঠ দল এনসিপি বলেছে, মৃত্যু ছাড়া তাদের ‘সেফ এক্সিট’ নেই। এছাড়া কিছু উপদেষ্টা এবং তাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় নানান প্রশ্ন দানা বেঁধেছে জনমনে। এসব আলোচনায় বিব্রত সরকারও।
অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও ইতোমধ্যে নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। সে লক্ষ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে জাতীয় একমত্য কমিশনের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে গণভোটের পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল। এই জুলাই সনদ আগামী ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষর হবে। তবে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের সময় নিয়ে দীর্ঘদিনের মিত্র দল বিএনপি এবং জামায়াতের সঙ্গে বিরোধ চলছে। বিএনপি স্পষ্ট জানিয়েছে, তারা পিআর ভোটে যাবে না। আর গণভোট নির্বাচনের দিনই হতে হবে। অন্যদিকে জামায়াত বলছে, ভোট পিআর পদ্ধতিতেই হতে হবে। অন্যথায় নয়। আর গণভোট হতে হবে নির্বাচনের আগে নভেম্বরে। এ দাবিতে সমমনা আরো ৬টি ধর্মভিত্তিক দল নিয়ে আন্দোলন করে আসছে জামায়াত। অন্যান্য দলগুলোও বিভক্ত। এই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিএনপি ও জামায়াত প্রশাসন দলীয়করণ নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছেন। এমনকি নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র কিংবা বানচাল করার অভিযোগ করছে দল দুটি। আর এজন্য কারো নাম প্রকাশ না করা হলেও উপদেষ্টাদের দোষারোপ করা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের গতকাল মঙ্গলবার বলেন, আমি সরকারকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আজকে হুঁশিয়ারি দিতে চাই না। প্রশাসনের যে অবস্থা এবং যে ষড়যন্ত্র চলছে, এটাকে বন্ধ করুন। নিরপেক্ষ সৎ লোকদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করুন। আর যদি না হয়, কোন কোন উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আমাদের কাছে নাম আছে। ৪-৫ জন উপদেষ্টা একটি দলের হয়ে কাজ করছে। তাদের কণ্ঠ রেকর্ড আছে। মিটিংয়ে তারা কী বক্তব্য দেন, এর খবর আছে। সংশোধন না হলে জনসমক্ষে নাম প্রকাশ করে দিব। জনগণ যদি জানে তারা জুলাইয়ের চেতনার সঙ্গে বেইমানি করছেন, তাহলে তাদের অবস্থা পতিত ফ্যাসিবাদের চেয়েও খারাপ হবে। তিনি আরো বলেন, একটি দলের লোকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে বসিয়ে নীলনকশার নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র চলছে। এতে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছেন না তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি ভালো মানুষ। অনেকে বলে আপনি সরল ও সোজা, প্যাচ বুঝেন না। আমরা বলব আপনার আশপাশের সবাই ভালো মানুষ নয়। আপনার কাছের কিছু লোক আপনাকে বিভ্রান্ত ও ব্যবহার করছে। তাদের সরান। না হয় জনগণ সরিয়ে দিবে। জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, হাসিনা ১৬ বছর টিকে ছিল। আর এভাবে চললে আপনারা কয়েক মিনিটও টিকতে পারবেন না।
উপদেষ্টাদের নিয়ে আবারো আক্রমণাত্মক হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমও। তিনি গতকাল মঙ্গলবার নেত্রকোনায় এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন না করে কারো জন্য কোনো ‘সেফ এক্সিট’ নেই। মৃত্যু ছাড়া নিরাপদ প্রস্থান অসম্ভব।’ এর আগে গত ৭ অক্টোবর নওগাঁয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সারজিস আলম বলেন, কিছু উপদেষ্টার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তারা কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্বটা পালন করেন; নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো। কিন্তু এত এত শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালনে যদি উপদেষ্টারা ভয় করেন তাহলে তাদের এই দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন নেই। যারা এ ধরনের চিন্তা করেন, তাহলে দেশের মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। কোথায় ‘সেফ এক্সিট’? ‘সেফ এক্সিট’ তো একমাত্র মৃত্যু, মৃত্যু ছাড়া তো তাদের ‘সেফ এক্সিট’ নেই। পৃথিবীর যে প্রান্তে যাক বাংলাদেশের মানুষ তাদের ধরবে।
সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে। তারা নিজেদের ‘সেফ এক্সিটের’ কথা ভাবতেছে। এটা আমাদের অনেক পোহাতে হচ্ছে এবং পোহাতে হবে। কিন্তু তারা যদি এটা বিশ্বাস করত যে তাদের নিয়োগকর্তা ছিল অভ্যুত্থানের শক্তি, রাজপথে নেমে জীবন দেয়া ও আহত সাধারণ মানুষজন এবং তারা যদি তাদের ওপর ভরসা করত, তাহলে উপদেষ্টাদের এই বিচ্যুতি হতো না। তিনি আরো বলেন, তাদের বিশ্বাস করে আমরা প্রতারিত হয়েছি। অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছে অথবা অভ্যুত্থানের সঙ্গে বিট্রে (প্রতারণা) করেছে। যখন সময় আসবে, তখন আমরা এদের নামও উন্মুক্ত করব। তার এই মন্তব্যের পর তোলপাড় শুরু হয় সরকার ও সব মহলে। যার রেশ এখনো চলছে। কারণ সরকারঘনিষ্ট হওয়ায় নাহিদ ইসলামের বক্তব্য গুরুত্ব পাচ্ছে। এছাড়া উপদেষ্টাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে গণঅধিকার পরিষদসহ আরো কয়েকটি দল। এনসিপির নেতাদের ‘সেফ এক্সিট’ খোঁজার অভিযোগ নিয়ে এখন পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে মন্তব্য করেছেন সিনিয়র ছয়জন উপদেষ্টা।
গত ৮ আগস্ট রাজধানীতে এক সেমিনারে সাবেক সচিব ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার অভিযোগ করেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির প্রমাণ তার কাছে রয়েছে।’ তবে তিনি কোনো উপদেষ্টার নাম উল্লেখ করেননি। তার এ বক্তব্যে সরকারসহ গোটা দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। যদিও পরের দিন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সাবেক সচিবের এই অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে বলে বিবৃতি দিয়েছে। পাশাপাশি কারো অসদাচরণের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকলে তা যথাযথ আইনগত ও তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়ার আহ্বান জানানো হয় মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের সই করা বিবৃতিতে।
গত এপ্রিলে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) ছাত্র প্রতিনিধি তুহিন ফারাবীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। এমনকি তাদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
এছাড়া মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদের’ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর প্রধান উপদেষ্টার একজন বিশেষ সহকারীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আতিক মোর্শেদ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। তাদেরও দুদকে তলব করা হয়েছিল। ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ প্রসঙ্গে সেসময় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কোনো এপিএস বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দুর্নীতির দায় তিনি যার সঙ্গে কাজ করেন, সেই মন্ত্রী বা উপদেষ্টার এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই এ ধরনের অভিযোগ উঠলে যথাযথ তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত বলে মনে করেন তিনি।
কোনো কোনো উপদেষ্টা এমনকি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আলোচনায় আসায় বিস্ফোরক মন্তব্য করেন সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল। গত ৫ অক্টোবর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত এই মন্তব্য ভাইরাল হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘জনদুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তদন্তের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দায়িত্ব ছাড়ার আগে তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা জরুরি। এতে সন্দেহভাজনদের পালিয়ে যাওয়া রোধ হবে, স্বাধীন ও কার্যকর তদন্ত নিশ্চিত হবে এবং জনগণের আস্থাও রক্ষিত থাকবে।’
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে আমি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি যে, আমি কখন নেমে যাই। মানে আমি কখন নামব আমি জানি না। আমার গদি কাল থাকবে কিনা।’ কারণ হিসেবে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মে মাস থেকে ছাত্র উপদেষ্টাদের পদত্যাগ চাওয়ার কথা জানিয়েছেন। ৫ আগস্টের পর বিএনপি ও জামায়াত, ভাগ-ভাটোয়ারা করে প্রশাসন দখল করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।