×

মুক্তচিন্তা

সমুদ্রের রাজনীতি নয়, কূটনীতিই হোক বাংলাদেশের শক্তি

Icon

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:১১ পিএম

সমুদ্রের রাজনীতি নয়, কূটনীতিই হোক বাংলাদেশের শক্তি

সমুদ্রের রাজনীতি। প্রতীকী ছবি

বঙ্গোপসাগর—নামের মধ্যেই এক গভীর ভূরাজনৈতিক অর্থ নিহিত। দক্ষিণ এশিয়ার এই নীল জলরাশি শুধু বাংলাদেশের না, এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতামূলক উপস্থিতি এই বঙ্গোপসাগরকে এক ধরনের কৌশলগত সংঘর্ষের মঞ্চে পরিণত করেছে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—নিজস্ব অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে, এই তিন পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্কের সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা। কারণ, ভুল এক পদক্ষেপ বাংলাদেশকে শক্তির প্রতিযোগিতার ঘূর্ণাবর্তে টেনে নিতে পারে। আবার সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারলে এই অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির দিগন্ত।

বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগর শুধু ভৌগোলিক সীমানা নয়, এটি আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। প্রায় ১১৮,০০০ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক এলাকা, যেখানে রয়েছে বিশাল মৎস্যসম্পদ, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, ও নৌ-বাণিজ্যের বিপুল সম্ভাবনা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশই এখন সমুদ্রপথে হয় এবং তার একটি বড় অংশ বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।

এই অঞ্চল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থল। ভারতের পূর্বাঞ্চল, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের বন্দরগুলো যেমন এর ওপর নির্ভরশীল, তেমনি চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’—দুই কৌশলই এই বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চায়। ফলে, বাংলাদেশের জন্য এটি একদিকে সুযোগের সমুদ্র, অন্যদিকে কূটনৈতিক ভারসাম্যের সূক্ষ্ম পরীক্ষা ক্ষেত্র।

বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বৃহত্তম দেশ হিসেবে ভারত এই অঞ্চলের এক পরাশক্তি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিরোধ আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে সামুদ্রিক সহযোগিতা বেড়েছে। ভারত এখন বঙ্গোপসাগরে ‘নেভাল সারভেইলেন্স নেটওয়ার্ক’ তৈরি করছে, যার অংশ হিসেবে বাংলাদেশও কিছু প্রযুক্তিগত সহায়তা পাচ্ছে।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। যৌথ বিদ্যুৎ প্রকল্প, সীমান্ত-বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্প—সব ক্ষেত্রেই ভারত একটি প্রভাবশালী অংশীদার। তবে ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় চীনের প্রভাবকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশকে তাই এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিতে হবে যাতে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট থাকে কিন্তু তা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।

চীন এখন বঙ্গোপসাগর ঘিরে যে ‘স্ট্র্যাটেজিক আর্ক’ তৈরি করছে, তা মূলত ভারতের দক্ষিণ সীমান্তে উপস্থিতি জোরদার করার অংশ। মিয়ানমারে কিয়াউকফিউ বন্দর, শ্রীলঙ্কায় হাম্বানটোটা এবং পাকিস্তানে গওয়াদর—এই তিনটি বন্দরকে ঘিরে গড়ে ওঠা ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ নীতিতে চীন এক ধরনের নৌবাণিজ্য ও নিরাপত্তা বলয় তৈরি করছে। বাংলাদেশে চীন এখন অবকাঠামো ও বিনিয়োগের অন্যতম বড় উৎস। পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, রেল সংযোগ, সেতু—প্রায় সব বড় প্রকল্পেই চীনের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ছোঁয়া আছে। যদিও চীন থেকে আমাদের রপ্তানির চেয়ে আমদানি পরিমাণ অনেক বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। চীন চায় বঙ্গোপসাগরে নিজের সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের জন্য তাই এই সম্পর্ক পরিচালনায় প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তার সামরিক প্রভাব বজায় রেখেছে। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ এবং ‘কোয়াড অ্যালায়েন্স’—এই দুই কাঠামোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীনের প্রভাব মোকাবিলা করতে চায়।

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে বহুমাত্রিক। বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক রপ্তানি গন্তব্য; বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে মার্কিন বাজার বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮.৬৯ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ১৮ শতাংশ। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিরাপত্তা সহযোগিতা, মানবাধিকার সংলাপ এবং সামুদ্রিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বেড়েছে। তবে ওয়াশিংটনের কৌশলিক প্রত্যাশা অনেক সময় ঢাকার পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্য নীতি’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে চায় বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক অক্ষের ঘনিষ্ঠ অংশ হোক, সেখানে বাংলাদেশ চায় নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে সবার সঙ্গে সমান সম্পর্ক রাখতে।

বাংলাদেশের ভারসাম্য রক্ষার কূটনীতি

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি—‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। একদিকে ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠতা, অন্যদিকে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব আর তৃতীয়দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উপস্থিতি এই ত্রিমাত্রিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা অনেকটা চ্যালেঞ্জের। ঢাকা বর্তমানে একটি ইকোনমিক হাব হয়ে উঠছে, যেখানে তিন দেশই বিনিয়োগে আগ্রহী। এই আগ্রহকে প্রতিযোগিতার বদলে পারস্পরিক পরিপূরক হিসেবে কাজে লাগানোই হবে বাংলাদেশের সাফল্য।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ প্রকাশ করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে—যেখানে বলা হয়েছে, এই অঞ্চলে বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো শান্তিপূর্ণ, উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সহযোগিতা। এটি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানও নয়, আবার চীনের পাশে নিরপেক্ষভাবে দাঁড়ানোও নয়—বরং এক বাস্তববাদী মধ্যপন্থা।

বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা মানে শুধু নৌবাহিনীর উপস্থিতি নয় এটি অর্থনৈতিক সীমানা, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সামুদ্রিক আইনের প্রতিপালনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—নিজস্ব সামুদ্রিক সক্ষমতা গড়ে তোলা।

বাংলাদেশ নেভির ‘ফোর্স গোল-২০৩০’ পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই এই দিকটিতে কাজ করছে। শুধু সামরিক শক্তি যথেষ্ট নয়। সমুদ্রের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ মহড়া, তথ্য বিনিময় ও আস্থা তৈরির উদ্যোগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের উচিত হবে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন দেশের মধ্যেই সহযোগিতামূলক কূটনীতি বজায় রাখা, যাতে বঙ্গোপসাগর প্রতিযোগিতার নয়, হয়ে ওঠে শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের ক্ষেত্র।

ভবিষ্যতের পথনির্দেশ

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা। যাতে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অন্য রাষ্ট্রের আস্থায় আঘাত না করে। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন দেশই বাংলাদেশকে ভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এর মধ্যে চীনের সঙ্গে অবকাঠামো, বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে অংশীদারিত্ব বজায় রাখা কিন্তু ঋণনির্ভরতার ফাঁদে না পড়া। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব ও ভৌগোলিক বাস্তবতার মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বাড়ানো, বিশেষত সীমান্ত, পানিবণ্টন ও সংযোগে। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সমুদ্র নিরাপত্তায় বাস্তবভিত্তিক সহযোগিতা জোরদার করা কিন্তু সামরিক ব্লকে জড়িয়ে না পড়া। এই তিনটি ভারসাম্যই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হওয়া উচিত।

বঙ্গোপসাগর আজ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দু হলেও বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সুযোগ। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—তিন দেশই এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট কিন্তু বাংলাদেশের শক্তি তার নিরপেক্ষতা ও বাস্তববাদী কূটনীতিতে।

যদি বাংলাদেশ তার নীতিগত অবস্থানে দৃঢ় থাকে, অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় এবং আঞ্চলিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেয় তবে বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠবে সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার নীল দিগন্ত। এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে—বাংলাদেশ কীভাবে তিন পরাশক্তির ভারসাম্য রক্ষা করে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে তার উপর। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল চালিকাশক্তি হওয়া উচিত ‘সমুদ্রের রাজনীতি নয়, বরং সমুদ্রের কূটনীতি’। যেখানে প্রতিটি ঢেউ বহন করবে সহযোগিতার বার্তা। আর প্রতিটি বন্দর খুলে দেবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

ক্রিট: ইউরোপীয় সভ্যতার জন্মভূমি || সময়, সাগর ও মানুষের গল্প

ক্রিট: ইউরোপীয় সভ্যতার জন্মভূমি || সময়, সাগর ও মানুষের গল্প

জুলাই সনদ, নাগরিক সচেতনতা এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

জুলাই সনদ, নাগরিক সচেতনতা এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

সমুদ্রের রাজনীতি নয়, কূটনীতিই হোক বাংলাদেশের শক্তি

সমুদ্রের রাজনীতি নয়, কূটনীতিই হোক বাংলাদেশের শক্তি

তোপের মুখে উপদেষ্টারা

তোপের মুখে উপদেষ্টারা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App