আরপিও সংশোধন ইস্যুতে নতুন করে টানাপড়েন শুরু
হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৪৫ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এবার যুক্ত হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)। জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত এই আরপিও সংশোধনী নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। জোট করলেও ভোট করতে হবে নিজস্ব দলীয় প্রতীকে- এমন বাধ্যবাধকতা আনা হয়েছে আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদে।
এছাড়া জামানত বাড়ানো এবং ‘না’ ভোটের সীমিতকরণ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এ নিয়ে গত তিন দিন ধরে তুমুল আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে আরপিওর আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। আদেশের সংশ্লিষ্ট ধারা আগের মতো বহাল রাখার দাবি জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আরপিওর কিছু পরিবর্তন ইতিবাচক হলেও জোটভুক্ত দলগুলোর প্রতীকে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ও জামানত বাড়ানোয় কিছুটা সংকট তৈরি হবে রাজনৈতিক দলগুলোতে। এতে ছোট দলগুলো নির্বাচনী প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়তে পারে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন অধ্যাদেশ-২০২৫’ এর খসড়া গত ২৩ অক্টোবর নীতিগত ও চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে। এটি এখন রাষ্ট্রপতি সইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। সংশোধিত আরপিও আইন ধরে আচরণবিধির গেজেট প্রকাশের ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি। ইতোমধ্যে সংসদ নির্বাচনে দল ও প্রার্থীর আচরণবিধি, ২০২৫ খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।
নির্বাচনী এই আইনে এবারের ভোটে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে যেটি নিয়ে বেশি আলোচনা ও আপত্তি উঠেছে তা হলো জোটগত ভোটে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করা। অর্থাৎ জোট মনোনীত প্রার্থী হলেও তাকে ভোট করতে হবে নিজের দলের প্রতীকে। বড় দলের জনপ্রিয় প্রতীকে ছোট দলগুলোর ভোট করার সুযোগ থাকছে না। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগতভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে আরপিওর ২০ নম্বর ধারায়।
আগে জোটগতভাবে নির্বাচন করলে জোটের শরিক দলের প্রতীক যেকোনো দল ব্যবহার করতে পারত। জোটগত নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের আগ্রহ থাকে বড় দলের প্রতীকের ভোট করার। এতে ভোটে জেতার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সেই সঙ্গে ‘না’ ভোট ফিরছে একক প্রার্থীর আসনে। কোনো আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী যদি একজন থাকে, তাহলে ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোটের বিধান থাকবে। তবে দ্বিতীয়বার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘না’ ভোট থাকবে না। এই ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা হয়েছে ১৯ নম্বর ধারায়। এছাড়া আদালত ঘোষিত ফেরারি আসামি ভোট করতে পারবে না- এমন বিধান রাখা হয়েছে। ১৫ বছর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় যোগ হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীর নাম; সমভোট পেলে হবে পুনঃভোট, জামানত বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা, দল আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা, আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং পদ্ধতি, এক কেন্দ্রে অনিয়মে পুরো আসনের ভোট বাতিল, এআইয়ের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) অপব্যবহার করলে নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য দিলে (ভোটে অযোগ্য এমন) নির্বাচিত হওয়ার পরও ব্যবস্থা নেয়া যাবেÑ এমন সংস্কার প্রস্তাবসংবলিত সংশোধিত আরপিওতে রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সংবিধান তৈরির পর নির্বাচন পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো আরপিও প্রণয়ন করা হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১৪ দফায় নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে এ আইনটিতে। এবার যে পরিবর্তনগুলো এসেছে তা আরপিও ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম সংস্কার। এর আগে বড় পরিবর্তন এসেছিল ২০০১ ও ২০০৮-০৯ সালে।
আরপিওতে এমন সংশোধন আনায় কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এতে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের মতে, এতে ভোট বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে বিএনপি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) জোটগতভাবে নির্বাচনে প্রতীকসংক্রান্ত নতুন বিধানে অসন্তুষ্টি রয়েছে। তারা বলছে, এক্ষেত্রে দলগুলোর সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা থাকা দরকার।
আরপিওর ২০ ধারার সংশোধনীর বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মো. ইসমাঈল জবিউল্লাহ সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বিএনপি এই সংশোধনের সঙ্গে একমত নয়। এই সংশোধনী বা পরিবর্তন বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ সংশোধনী থেকে সরে এসে আরপিওর আগের বিধান বহাল রাখার অনুরোধ জানিয়ে আমরা সিইসির কাছে আনুষ্ঠানিক পত্র দিয়েছি।’ জোটের বা নিজেদের দলের প্রতীক নিয়ে ভোট করা গণতান্ত্রিক অধিকার। অতীতে এ নিয়ে কোনো জটিলতা, সমস্যা সৃষ্টি হয়নি। কোনো দলের পক্ষ থেকে এ বিধান সংশোধনের দাবি এসেছে বলেও তাদের জানা নেই। ইসমাইল জবিউল্লাহ উল্লেখ করেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিমত চাওয়া হয়। বিএনপি আরপিওর বিভিন্ন অনুচ্ছেদে সংশোধন প্রস্তাবে মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বলে, আরপিওর ২০ নম্বর অনুচ্ছেদ, অর্থাৎ দল বা জোটের প্রতীক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিবর্তনের প্রস্তাবের সঙ্গে তারা একমত পোষণ করে না।
বামজোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, জামানত বাড়ানো হয়েছে, এতে আমাদের আপত্তি রয়েছে। এতে যাদের অর্থ কম, তারা ভোটে অংশ নিতে পারবে না। এটি হবে ধনীদের ভোট, গরিবরা শুধু ভোট দেবে। এটা এক ধরনের বৈষম্য। ‘না’ ভোটের বিধান রয়েছে, কিন্তু সেটা শুধু একক প্রার্থীর বিপরীতে। সব জায়গায় ‘না’ ভোটের বিধান থাকা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন কমিশনের মূল স্টেকহোল্ডার রাজনৈতিক দল। আরপিওতে এত বড় সংশোধন আনা হলেও রাজনৈতিক দলের কোনো মতামত নেয়া হয়নি। এসব সংশোধনীর অনেক বিষয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। আমরা এগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছি। কমিশন যখন আমাদের সংলাপে ডাকবে, তখন আমাদের আপত্তির বিষয়গুলো উপস্থাপন করব।
তবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগত নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান অন্তর্ভুক্তিতে দ্বিমত নেই জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপিরও। এ বিষয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, প্রতিটি দলের একটা নিজস্বতা আছে। দলীয় প্রতীক দলের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই নিবন্ধিত দলগুলোর নিজস্ব পরিচয়ে যাওয়াই উত্তম।
