যাদুকাটার বালু নিয়ে ‘হরিলুট’
রাসেল আহমদ, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ), যাদুকাটা থেকে
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৯ পিএম
ছবি : ভোরের কাগজ
সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীতে চলছে বালু লুটের মহোৎসব। এই ‘হরিলুটে’ হুমকির মুখে রয়েছে নদীর তীরবর্তী বসতবাড়ি ও কৃষিজমি থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, ৮৬ কোটি টাকার আরেফিন-অদ্বৈত মৈত্রী সেতু এবং ঐতিহ্যবাহী অদ্বৈত মন্দিরের মতো স্থাপনা। দীর্ঘদিন ধরে ইজারাদার এবং বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের লোকজন মিলে এই নদীতে লুটপাট চালিয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি নেতাদের মিত্র হিসেবে পেয়েছেন ইজারাদাররা। বিশেষ করে গত ৭ থেকে ১১ অক্টোবর ৫ দিনে প্রায় শত কোটি টাকার বালু লুটের ঘটনায় স্থানীয়রা হতভম্ব।
রূপ ও সম্পদের নদীখ্যাত যাদুকাটার উৎপত্তি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড় থেকে। নদীটি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বারেকটিলা ও লাউড়গড়ের মাঝ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। একসময় এর দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ কিলোমিটার আর গড় প্রস্থ ৫৭ মিটার (১৮৭ ফুট)।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মিলেমিশে লুট হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত নদী যাদুকাটার খনিজ বালু। ইজারাদার, রাজনীতিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় দুর্বৃত্তরা এই লুটের অংশীদার। ভাগ-বাটোয়ারায় কমবেশি হলেই লুটপাটে যুক্তরা একে অন্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন।
সম্প্রতি কয়েকদিনের বালু লুটের কাণ্ডে প্রশাসনে বেশ তোড়জোড় শুরু হয়েছে। প্রশাসনের অভিযানে অনেক নিরীহ শ্রমিকের জেল-জরিমানা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন অন্তরালের বালুখেকো মহাজনরা। যদিও একাধিক মামলায় আলোচিত কয়েকজনের নাম সামনে এসেছে।
গত ১৪ অক্টোবর তাহিরপুর থানায় বালুমহাল ও বালু ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ এর ১৫ ধারায় ৫১ জনের নাম উল্লেখপূর্বক অজ্ঞাতনামা ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। একই দিনে তাহিরপুর থানার এসআই পংকজ দাশ বাদী হয়ে ৪ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন।
সুনামগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাইমিনুল হকও ৩৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২০ জনকে আসামি করে তাহিরপুর থানায় আরেকটি মামলা করেন।
ইজারাদারের পক্ষে করা মামলার আসামি নিয়ে সমালোচনা হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাকর্মীসহ আলোচিত কয়েকজনের নাম আছে। এ মামলায় উপজেলার সোহালা গ্রামের বাসিন্দা তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও স্থানীয় বাদাঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহবায়ক আফতাব উদ্দিন, তার বড়ভাই উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক রাখাব উদ্দিন, উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা বিশ্বজিৎ সরকার, নদীতীরের বাসিন্দা মোশাহিদ আলম ওরফে রানু মেম্বারের নাম আছে। রানু মেম্বার একই অভিযোগে এর আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত কয়েকদিনে ইজারাবহির্ভ‚ত নদীর পাড় ও জায়গা থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন সংক্রান্ত মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন লাউড়গড় গ্রামের আওয়ামী লীগ সমর্থক আব্দুল কাইয়ুম খেলু মাস্টার, বাদাঘাট ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি খাজা মাঈন উদ্দিন, একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ কর্মী আবু বক্কর, ৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী রফিকুল ইসলাম, পুরান লাউড়গড় গ্রামের তিন সহোদর- শিপন, শোভন, শাহান, বাদাঘাট ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী গোলাপ মাহমুদের চাচাতো ভাই ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি প্রার্থী আব্দুল মান্নান।
স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মী জানিয়েছেন, লাউড়েরগড় আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসর প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাইয়ুম খেলু মাস্টার ও বাদাঘাট ইউনিয়নের লাউড়গড় গ্রামের খাজা মাঈনউদ্দিন পাড় কাটা নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন। সাধারণ শ্রমিকরা এদের নাম বলাবলি করছেন। প্রথমে তারাই বালু নিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পরে তারাই প্রভাবশালীদের সঙ্গে সমঝোতা করে বালু লুট শুরু করে।
সুনামগঞ্জের পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও বাদাঘাট এলাকার আবুল হোসেন বলেন, যাদুকাটার পাড় কাটা কর্মকাণ্ডে এখন ‘ঠেলার নাম বাবাজী’ অবস্থা প্রশাসনের। সবকিছু ধামাচাপা দেয়ার জন্য নোটিস দেয়া, নদীর তীরে বাঁশের বেড়া দেয়া পর্যন্ত কত আয়োজন। এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে কারা জড়িত সেটা পুলিশ, বিজিবি ও প্রশাসন জানে। পাশাপাশি সব ইজারাদারের খেয়াল-খুশিতেই হচ্ছে।
জেলার বড় বালুমহাল যাদুকাটা-১ ও যাদুকাটা-২ নিয়ে এতদিন মামলা চলছিল। সর্বশেষ ১৯ আগস্ট শ্রমিকদের স্বার্থ, পাড় না কাটা এবং যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন না করার শর্তে বালুমহাল ইজারা দেয়ার পক্ষে মত দেন আদালত। পরবর্তীতে এ দুই বালুমহাল ১০০ কোটি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকায় ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। চলতি মাসে প্রশাসন ইজারাদারদের বালুমহাল বুঝিয়ে দিলে বালু উত্তোলন শুরু হয়, যা যাদুকাটা ধ্বংসের শেষ সীমা পর্যন্ত নিয়ে যায় বালু লুটকারীরা। যদিও ২৬ আগস্ট ফেসবুক পেজে পোস্ট করে সুনামগঞ্জের নদ-নদী ও মহালগুলোতে বালু লুটের ঘটনা ঘটতে পারে- এমন আশঙ্কা করেছিল জেলা প্রশাসন। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করেও প্রশাসন বালু লুট ঠেকাতে পারেনি। নিরীহ শ্রমিক জেল-জরিমানার শিকার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে অন্তরালের বালুখেকো মহাজনরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক যুবক জানিয়েছেন, কয়েকদিন আগে পাড় কাটার জন্য যাদুকাটার তীরে হাজার হাজার নৌকা ঢুকেছে। পারের মালিক নামধারী লোকজন নল (১০ ফুটে এক নল) হিসেবে যাদুকাটার পাড় ইজারাদার পক্ষ কিংবা অন্য প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। পরে তারা রয়্যালটি ২৫ টাকা ছাড়াও প্রতি ফুটে ২০ টাকা আদায় করেছে নৌকাওয়ালাদের কাছ থেকে। গত কয়েকদিনে লাউড়গড় বিজিবি ক্যাম্প থেকে জিরো পয়েন্টসহ আশপাশ এলাকার প্রায় তিন নল করে পাড় কাটা হয়েছে। ভাগে যখন কম পড়ে তখন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলা শুরু করে। মূল হোতাদের বাদ দিয়ে নিরীহ শ্রমিকদের জেল-জরিমানা দেয়া হচ্ছে, এ সব লোক দেখানো। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, স্থানীয় প্রভাবশালী, প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তি- সব মিলেমিশেই হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ইজারাদার শাহ রুবেল আহমদ বলেন, আমরা শুরু থেকেই ইজারা বহির্ভ‚ত জায়গা থেকে বালু কাটার পক্ষে নই। প্রায় দুইশ নিরাপত্তা কর্মী দিয়ে এগুলো প্রতিহতের চেষ্টা করেছি। ইজারাবঞ্চিত প্রতিপক্ষ পুরনো ছবি ভাইরাল করে আমাদেরকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। নদীর পাড় কেটে বালু তোলা বন্ধে সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পের আবেদন করেছি। বালু লুট ঠেকাতে বাধ্য হয়ে নদীর তীরে বাঁশের বেড়া দিচ্ছি আমরা।
সম্প্রতি সরজমিন বালু-পাথরের এই খনি দেখে মনে হয়েছে যাদুকাটা এখন তীরহারা এক প্রশস্ত নদী। দিন-রাত অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে একসময়ের অপ্রশস্ত যাদুকাটা এখন বসতবাড়ি, কৃষিজমি, রাস্তাঘাট হারিয়ে নিঃস্বপ্রায়। হুমকির মুখে নদীকেন্দ্রিক হাওর-বাওড়, চর, ছড়া, পর্যটন স্পট শিমুল বাগান, বিজিবি ক্যাম্প, ঘাগটিয়া, লাউড়গড়, গড়কাটি, রাজারগাঁও, মোদেরগাঁওসহ অন্তত ১৫-২০টি গ্রাম, অদ্বৈত মন্দির, ৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য আরেফিন-অদ্বৈত মৈত্রী সেতুসহ অনেক স্থাপনা।
সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, পাড় কাটতে কাটতে এই নদীর গড় প্রস্থ এখন এক কিলোমিটারের বেশি। ইজারার নিয়ম অনুযায়ী সনাতন পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনের কথা। কিন্তু সেইভ মেশিন (শ্যালো ইঞ্জিনচালিত যন্ত্র) ও ড্রেজারের তাÐবে নদীর বুক ও তীরবর্তী এলাকা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে বলছেন স্থানীয়রা।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইজারাদার কর্তৃক যাদুকাটার প্রতি ঘনফুট বালুর টোল (রয়্যালটি ) ছিল ১১ টাকা। ৫ আগস্টের পরে বিএনপির নেতাদের প্রতিবাদের মুখে সেই রয়্যালটি আদায় হয়েছে ৯ টাকা। কিন্তু এখন এক লাফে ২৫ টাকা আদায় হলেও সেই আন্দোলনে বিএনপির প্রথম সারির নেতারা নীরব রয়েছেন।
বিএনপি কিছু কিছু নেতাকর্মীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করে সুনামগঞ্জ-১ আসনে দলীয় মনোনয়ন-প্রত্যাশী কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, রয়্যালটি র বিষয়টি আমি প্রশাসনকে অবহিত করেছি। এ ব্যাপারে আমি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি বলেন, যাদুকাটা একসময় প্রায় ৪০০ ফুট চওড়া ছিল। পাড় কাটা কর্মকাণ্ডে এখন হাজার ফিট হয়েছে। নদীর পরিবেশ, তীরবর্তী বসতি, স্থাপনা রক্ষায় কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
যাদুকাটা রক্ষায় বালুমহাল বিলুপ্ত করে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার দাবিতে ৮ অক্টোবর সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে মানববন্ধন করেছে যাদুকাটা নদী রক্ষা আন্দোলন।
গত ২ অক্টোবর বালু লুটের তাণ্ডব ঠেকাতে নদীর পূর্ব তীরে লাউড়গড় বিজিবি ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী চরে নেমে আসে কয়েক হাজার মানুষ। অবস্থা বেগতিক টের পেয়ে পিছু হটে দুষ্কৃতকারীরা।
জানা যায়, নদীর পাড় কাটা শুরু হয় ২০০১ সাল থেকে। শুরুর দিকে রাতের আঁধারে পাড় কাটা হলেও ২০২১ সালে বালুমহাল ইজারার পর দিনরাত চলে নদী ও পাড় কাটার মহোৎসব। নদীর তীরবর্তী জায়গা রক্ষা করতে না পেরে ভ‚মি মালিকরা বালুখেকো চক্রের কাছে বিক্রি করার পাশাপাশি কেউ কেউ বিনামূল্যেই জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
তাহিরপুর থানার ওসি মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, নদীর পাড় কাটার বিরুদ্ধে ইজারাদারের পক্ষ থেকে ৫১ জনসহ ৪ জনকে অভিযুক্ত করে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। যাদুকাটা নদীর পরিবেশ এখন শান্ত। অভিযুক্তদের ধরতে আমাদের আইনি কার্যক্রম চলমান আছে।
সুনামগঞ্জ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল জাকারিয়া কাদির বলেন, গভীর রাতে ইজারা বহির্ভূত এলাকায় বালু উত্তোলন শুরু হয়। যা বিজিবির একার পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনকে আমরা লিখিতভাবে অবহিত করেছি। একটি স্থায়ী পোস্ট স্থাপন, নিয়মিত টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনা এবং অনিয়ম করলে ইজাদারের ইজারা বাতিল করার ব্যাপারে আমরা প্রস্তাবনা তুলে ধরেছি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, যাদুকাটার পাড় কাটার ঘটনায় ইজারাদারকে শোকজ করা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ইজারা বাতিল হবে।
