ভূমিকম্প
ঝুঁকিতে ঢাকার ৬ লাখ ভবন
আজিজুর রহমান জিদনী
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৩২ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভত হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে শুরু হয়ে ২০ সেকেন্ড স্থায়ী এই ভূমিকম্পে ইতোমধ্যে ৯ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। অনেক জায়গায় ভবনে ফাটল দেখা দেয়াসহ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে ঢাকার বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবনগুলো কতটা ভূমিকম্প নিরোধক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঐতিহাসিক নিয়মে ১৫০ বছর পরপর যে ভ‚মিকম্প বাংলাদেশে ফেরার আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার আসার সময় হয়েছে। গতকালের ভূমিকম্পকে তারই আলামত হিসেবে দেখা হচ্ছে। হিসাব বলছে, ঢাকা শহরে মোট ২১ লাখ ভবন আছে। এর মধ্যে ১৫ লাখ ১-২ তলা ও বাকি ৬ লাখ ভবন ছয়তলার উপরে। বড় ভূমিকম্প হলে এই ৬ লাখ ভবন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাসহ বাংলাদেশে যদি ফের ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়; তাহলে রাজধানীর ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৩৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়বে। ২-৩ লাখ মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটবে। বেঁচে থাকাদের পালিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ থাকবে না। বীভৎস অবস্থা হবে। আগুন, পানি ও পয়োপ্রণালির ব্যবস্থাপনার যে অবস্থা, শুধু এগুলোর গন্ধে কেউ থাকতে পারবে না। ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কারও অসাধ্য হয়ে উঠতে পারে।
তারা আরো বলছে, তাই এখন থেকে ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা চিহ্নিত করে শক্তিশালী করার কাজে হাত দিতে হবে। কারণ দুর্বলভাবে তৈরি ভবনের কারণেই ভূমিকম্পে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১০ সালের হাইতি ও চিলির ভূমিকম্পের তুলনা করলে ভূমিকম্পের ঘটনায় কাঠামোগত ব্যর্থতার কারণে মানবিক ক্ষতি বেশি হতে দেখা যায়। সে বছর হাইতিতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল। যার প্রধান কারণ ছিল দুর্বলভাবে নির্মিত ভবন। একই বছর চিলিতে আঘাত হানে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প, যাতে ২৮০ জন প্রাণ হারায়। চিলির ভবনগুলো নির্মাণে শক্তিশালী কৌশল ব্যবহার করা হয়। গত ২০২৩ সালে তুরস্কে ভূমিকম্পে ভবনধসের মাধ্যমে প্রায় ৫৩ হাজার ৫০০ মানুষ নিহত হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুর্বলভাবে ভবন নির্মাণের কারণে সেসব এলাকায় দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু বেশি হয়।
এই ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য সজাগ হওয়ার বার্তা উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আজ (গতকাল) ১০টা ৩৮ মিনিটে এই ভূমিকম্প আঘাত হানে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) মাত্রা দেখাচ্ছে ৫ দশমিক ৫। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর মাধবদীতে, ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। বাংলাদেশে এমন ভূমিকম্প হওয়ারই কথা। রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সবকিছু ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বা এই ভূখণ্ডে বড় ভূমিকম্পের মধ্যে আছে ১৭৬২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৫। এটি গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক নামে পরিচিত। এর ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ফেনী ও এমনকি কুমিল্লা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর ১৮৯৭ সালে আসামে সংঘটিত ভূমিকম্প ছিল ৮ দশমিক ৭ মাত্রার। ১৯১৮ সালে সিলেটের বালিসিরা উপত্যকায় ৭ দশমিক ৬ মাত্রায় ও ১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়িতে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। বড় ভূমিকম্পগুলো ১৫০ বছর পরপর ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। এদিক থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার সময় হয়ে গেছে। তাই এই ভূমিকম্পের পর সবাইকে সচেতন ও সাবধান হতে হবে। এখন রাজধানীর ভবনগুলো পরীক্ষা করতে হবে। কারণ, অনেকেই বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করে না।
মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, আমাদের ভবনগুলো কালার ক্লাসিফাইং করতে হবে। ভূমিকম্প রোধে যা আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে করা হয়েছে। এখানে ভূমিকম্প প্রতিরোধক ভবনগুলোকে সবুজ রং করে আলাদা করা হবে। মাঝামাঝি অবস্থায় থাকা ভবনগুলোকে হলুদ বা কমলা রং করে আলাদা মার্ক করে সেগুলো শক্তিশালীকরণে কাজ করতে হবে। আর একদম দুর্বল ভবনকে লাল রঙের মার্ক করে ভাঙার ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও আরো প্রয়োজন, তবে আমাদের দেশে অনেক প্রশিক্ষিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা এ নিয়ে কাজ করতে পারে। তবে আমাদের একটা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে যারা সার্বিক বিষয়ে কাজ করবে। বিশ্বব্যাংক ভূমিকম্প মোকাবিলাসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) কয়েক কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে জানিয়ে মেহেদি আহমেদ আনসারী জানান, কিন্তু রাজউকের সেই সামর্থ্য নেই।
রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের যে আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশে ৫ বা এর উপরে ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে একটা ডিজাসটার হয়ে যাবে। সেখানে ৫.৫ বা ৫.৭ রিখটার স্কেল ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বলা হচ্ছে। সেই ধরনের তেমন কিছু না হলেও বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এ ঘটনার পর থেকেই রাজউকের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আলাতুনন্নেছা স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সিলগালা করেছি। রাজধানী ঘুরে আমরা ২৮টি ভবন শনাক্ত করে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড লাগিয়েছি। পুরান ঢাকায় ভূমিকম্পের প্রভাব যেহেতু বেশি দেখা দিয়েছে; আগামী সোমবার ওইসব এলাকার বিভিন্ন পেশাজীবী সঙ্গে একটি ওয়ার্কশপ করব আমরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক ভূমিকম্প মোকাবিলাসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য রাজউককে কোটি কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দিয়েছে কিন্তু রাজউকের সেই সামর্থ্য নেই। প্রশ্নর জবাবে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা ভূমিকম্প প্রতিরোধক ভবন নির্মানের বিষয়টি দেখে থাকি। আর এর পরবর্তী কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন ও সশস্ত্র বাহিনী মোকাবিলা করে। আমি দ্বায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কিন্তু কাজ করে যাচ্ছি। আমরা এখন জাইকার ডিসিপিআর প্রকল্পের মাধ্যমে যে ভবনগুলো নতুন করে প্ল্যান দিচ্ছি; সেগুলো ভূমিকম্পন সহনীয় পর্যায় দেখে তা ডিজাইনে অন্তর্ভুক্ত করছি। এছাড়া আমরা একটা ট্রাস্ট করছি। যেখানে ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মহাখালীতে এর অফিস হবে। পূর্ত সচিব ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হবেন। রাউজউক চেয়ারম্যান হবেন ভাইস চেয়ারম্যান। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সিটি করপোরেশন, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ, ইঞ্জিনিয়ার ও প্ল্যানার্সসহ মোট ১৫-১৬ জনের সমন্বয়ে ট্রাস্ট পরিচালিত হবে। ট্রাস্ট গঠনের কাজ শেষ প্রায়। চলতি বছরের ডিসেম্বরের শুরুতেই কাজ শুরু করবে ট্রাস্ট। তারা শুধু রাজধানীর ভবনগুলো ভূমিকম্পন সহনীয় কিনা তা শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে কাজ করবে। ভবন ভূমিকম্পন সহনীয় কিনা তা পরীক্ষার জন্য ইতোমধ্যে ৬৫ কোটি টাকার ইকুইপমেন্ট কেনা রয়েছে আমাদের। এগুলো ট্রাস্ট ব্যবহার করবে। রাজধানীতে কত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ সে বিষয়ে জানাতে না পারলেও ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, আমরা জরিপ যৌথভাবে করেছিলাম। তবে সেখানে মূলত ঝুঁকিপূর্ণ স্কুল-কলেজগুলোর তালিকা করা হয়েছিল।
মাঠে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (অপারেশনস) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ ভোরের কাগজকে জানান, রাজধানীর ঢাকার ৭-৮ লাখ ভবন একদম ঝুঁকিপূর্ণ। গতকালের চেয়ে ভূমিকম্পের মাত্র আরো কয়েক রিখটার স্কেল বেশি হলে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে ব্যাপক। তিনি বলেন, আমাদের এখানে কমিউনিটি রেসকিউয়ে বেশি জোর দিতে হবে। কারণ এমন ভূমিকম্প হলে ফায়ার সার্ভিসসহ যে কোনো সাহায্য চাইলেই পাওয়া যাবে না বা দেয়াও সম্ভব না হতে পারে। সেখানে কাজ করবে আপনার সমাজের আশপাশের রক্ষা পাওয়া মানুষরা। তারা আপনার সহায়তায় দ্রুত এগিয়ে যাবে। সেজন্য প্রত্যেক মহল্লায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ফায়ার সার্ভিস বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তর বলছে, আমাদের স্বেচ্ছাসেবী তৈরি আছে; তা পর্যাপ্ত না। আর শিক্ষাসহ সব প্রতিষ্ঠানে বারবার সচেতনতা মহড়া করতে হবে। খুব ভয়াবহ হলে ভূমিকম্প সর্বোচ্চ ধরে নেই ৩০-৪৫ সেকেন্ড হবে। আমাকে বোঝতে হবে সেই সময়টুকু আমি কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পারি। ভূমিকম্পসহ শহরে যে কোনো দুর্যোগে সিটি করপোরেশনের অধীনে ফায়ার ও সশস্ত্র বাহিনীসহ সবাই কাজ করে। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনায় সিটি করপোরেশনের কাউকে দেখা যায় বলে অভিযোত করেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এমন বিপদ ঘটলে উদ্ধারকারী সংস্থাও নিজেকে উদ্ধারে ব্যস্ত থাকতে পারে। তাই সামাজিক বা কমিউনিটি উদ্ধার কার্যক্রমে ব্যাপক জোর দিতে হবে।
গতকাল শুক্রবার ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে ভূমিকম্পের প্রসঙ্গে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গত পাঁচ বছরে এত জোরে, এত শক্তিশালী ভূমিকম্প আমরা অনুভব করিনি। এটা বারবার আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। এটাকে আমলে নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ঢাকা শহরে খোলা জায়গা নেই। দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাইকে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অগ্নিঝুঁকি, ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় তিন বছরের পরিকল্পনা নিয়ে আগানো উচিত।
