ভূমিকম্প-অগ্নিঝুঁকি
হিসাব নেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের
মুহাম্মদ রুহুল আমিন
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:০৭ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকায় যে কোনো মুহূর্তে ভূমিকম্প বা বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সম্পর্কে সঠিক কোনো হিসাব নেই। ফলে ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কিন্তু এসব ভবন চিহ্নিত ও অপসারণে সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার প্রায় ৭৪ শতাংশ ভবন নকশাবহির্ভূতভাবে গড়ে উঠেছে।
সঠিক তালিকা না থাকায় শহরে কতগুলো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, তা কারো জানা নেই। সেফটি অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক সেমিনারে জানানো হয়, নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঢাকায় প্রায় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। এই ভবনগুলো ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ডে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এসব বিষয়ে স্থপতি ও নগরবিদ মো. ইকবাল হাবিব সম্প্রতি বলেন, ঢাকার ১৩ শতাংশ এলাকায় কোনো ধরনের ভবন নির্মাণ করা উচিত নয়; কিন্তু হাউজিং কোম্পানিগুলো অনুমোদন ছাড়াই বহু ভবন তৈরি করছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙা হচ্ছে না, কিন্তু নতুন ভবন নির্মাণ চলছে। এতে সাধারণ মানুষের জন্য ঝুঁকি আরো বেড়ে যাচ্ছে।
আরো পড়ুন : আগুন ঝুঁকিতে রাজধানী, প্রস্তুতি-নজরদারী সীমিত
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফাটলের খবরও ক্রমেই বাড়ছে। ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরান ঢাকা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও বাড্ডার অনেক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভ‚মিকম্পের পর আতঙ্ক তৈরি হয় ঢাকাজুড়ে। ওইদিন ভূমিকম্পের কারণে ১০ জনের মতো মানুষও মারা গেছেন।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ২০১৮-২০২৩ সালের মধ্যে পরিদর্শিত ১ হাজার ১৮১টি বহুতল ভবনের মধ্যে ৩৬৭টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৭৪টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিপণিবিতান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সুপারিশ ও নোটিশ জারি সত্ত্বেও কেউ কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেছিলেন, নির্দেশনার পরও নানা কারণে ভবনগুলো ভাঙা হয়নি। আমরা বারবার নোটিশ দিয়েছি। আশা করি ভবিষ্যতে সবাই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।
গতকাল ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ভূমিকম্পে ঝুঁকি রোধে একাধিক সংস্থার দায়িত্ব রয়েছে। ভবনের নকশা অনুমোদন ও তদারকি দুটোই রাজউকের দায়িত্ব হলেও, তদারকির দায়িত্ব অন্য সংস্থাকে দিলে কার্যকরভাবে ঝুঁকি রোধ করা সম্ভব। শুধু রাজউক নয়, সরকারি অনেক সংস্থারও দায়িত্ব রয়েছে। তিনি আরো বলেন, রাজউকের চেয়ারম্যান হিসেবে আমার অবস্থান অনেকটা আসামির মতো। নগর পরিকল্পনা ও ভবন নির্মাণে যদি কোনো ত্রুটি বা দুর্নীতি থাকে, তার জন্য আমার অফিস দায়ী। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে বাস্তবায়ন সহজ নয়।
সম্প্রতি ঢাকার কসাইটুলি এলাকায় ভূমিকম্পের পর দেখা গেছে, ত্রুটিপূর্ণ ভবনের মালিক এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এলাকাবাসী রাজউকের সঙ্গে সমন্বয় করে সমস্যার সমাধান করছে। অবৈধ ভবন নির্মাণকারীদের বিদ্যুতের মিটার জব্দ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে মামলা ও ভবন ভাঙার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। উপযুক্ততা যাচাই ছাড়াই নকশায় স্বাক্ষর করা প্রকৌশলী ও স্থপতিরা শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
জানা গেছে, ‘রাজউক অংশ’ অনুযায়ী, গত বছরে ঢাকা অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি ভবনের তালিকা তৈরি করা হলেও অধিকাংশ এখনো ভাঙা হয়নি। পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনও তালিকায় রয়েছে।
গতকাল ঢাকায় ডিবেট ফর ডেমোক্র্যাসির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যান আরো বলেন, রাজউকের আওতায় থাকা সত্ত্বেও ভবন নির্মাণে হাউজিং কোম্পানি বিল্ডিং কোড মানছে না। কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও এতে জড়িত। রাজউকের অবস্থান কঠোর। তবে দুর্নীতি রাতারাতি দূর করা যায় না। চেয়ারম্যান আরো বলেন, যেসব প্রকৌশলী ও স্থপতিরা উপযুক্ততা নিশ্চিত না করে ভবনের নকশায় স্বাক্ষর করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইতোপূর্বে যারা তথ্য গোপন ও জালিয়াতির মাধ্যমে একাধিক প্লট নিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কেরাণীগঞ্জ, বসিলা, ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাশয় ভরাট করে যেসব হাউজিং কোম্পানি অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণ করছে তাদের ব্যাপারে রাজউকের অবস্থান কঠোর।
ডিবেট ফর ডেমোক্র্যাসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকিপ্রবণ এই দেশে অচিরেই বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের আতঙ্ক আছে কিন্তু সচেতনতা নেই। বর্তমান বিল্ডিং কোড সময় উপযোগী নয়। এটি আধুনিকায়ন করতে হবে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় শর্টটাইম এবং লংটাইম রোডম্যাপ করা জরুরি। বিগত সরকারের আমলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সচেতনতা তৈরিতে প্রচুর অর্থ খরচ করা হলেও প্রস্তুতিতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। ভূমিকম্পের ঝুঁকি রোধে সম্পৃক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গলদ আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই এক্ষেত্রে বড় বাধা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে প্রায় সবাই আমলা। সেখানে কোনো ইঞ্জিনিয়ার বা জিওলোজিস্ট নাই। তিনি বলেন, রাজউকের আওতাধীন থাকা স্বত্তেও ভবন নির্মাণে ঢাকার আশপাশের গজে উঠা হাউজিং কোম্পানিগুলো বিল্ডিং কোড, নকশার তোয়াক্কা করছে না। কোনো রকম নিয়মনীতি না মেনে যে যার মতো করে ১৫ তলা ২০ তলা ভবন নির্মাণ করছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজউক তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অবৈধ ভবন নির্মাণের সঙ্গে রাজউকের কিছু অসাধু কর্মচারী জড়িত। রাজউকের অনিয়ম বন্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। টাকা ছাড়া রাজউকে কোনো কাজ হতো না। তবে বিগত সময়ের দুর্নীতি রাতারাতি সংশোধন করা কঠিন। ভবন মালিকের ক্যাপাসিটির সীমাবদ্ধতা রয়েছে, ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারকেই প্রথম এগিয়ে আসতে হবে। সরকার যে রাস্তাঘাট, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এলিভেটর এক্সপ্রেস নির্মাণসহ গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন তৈরি করছে সেগুলোও ভূমিকম্প সহনশীল হতে হবে।
রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের এই বাস্তবতা প্রমাণ করছে, হিসাব থাকলেও কার্যকর উদ্যোগ নেই। অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে লাখো মানুষ প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে বসবাস করছে। সঠিক সময়ের প্রণোদনা ছাড়া, শহরের নিরাপদ ভবনের স্বপ্ন শুধু কাগজেই রয়ে যাবে।
