গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তি পেলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৪৮ পিএম
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে নতুন ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে দেশটির পার্লামেন্ট। একই সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ দেশটিতে স্বৈরতন্ত্রের পথ আরো প্রশস্ত করবে।
বৃহস্পতিবার স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী আনুষ্ঠানিকভাবে আইনে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের শীর্ষ আদালতগুলোর পরিচালনা কাঠামোতেও আসছে বড় পরিবর্তন।
পরিবর্তনের পক্ষে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, এটি সশস্ত্র বাহিনীকে আরো স্পষ্ট প্রশাসনিক কাঠামো দেবে এবং আদালতের মামলার জট কমাতেও সহায়তা করবে।
পারমাণবিক অস্ত্রধারী এই দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে- কখনো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, কখনো পর্দার আড়ালে থেকে। পাকিস্তানের ইতিহাসে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও জিয়া-উল-হকের নিয়ন্ত্রণ দেশটিকে বারবার অস্থির করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বেসামরিক–সামরিক ক্ষমতার দীর্ঘদিনের ‘হাইব্রিড শাসন’ এখন সেনাবাহিনীর পক্ষে ঝুঁকে পড়ছে।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ইঙ্গিত- পাকিস্তান আর হাইব্রিড সিস্টেমে নেই; বরং পোস্ট-হাইব্রিড সিস্টেমে প্রবেশ করেছে।
আরো পড়ুন : সংবিধান সংশোধন: সেনাপ্রধানের ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ আসছে যেসব পরিবর্তন
সংশোধনী অনুযায়ী, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে দায়িত্বে থাকা সেনাপ্রধান মুনির এখন নৌ ও বিমান বাহিনীরও তত্ত্বাবধায়ক হবেন। তার ফিল্ড মার্শাল পদবি ও ইউনিফর্ম আজীবনের জন্য বহাল থাকবে। অবসর গ্রহণের পরেও প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পরামর্শে তাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও কাজ দেওয়া হবে। তাই তিনি আজীবন জনপরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সমর্থকদের যুক্তি-এটি সামরিক কমান্ড কাঠামোকে আরো স্পষ্ট করবে এবং আধুনিক যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। পাকিস্তান সরকারের সংবাদ সংস্থা এপিপি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে- এটি বৃহত্তর সংস্কার এজেন্ডার অংশ।
তবে সমালোচকদের মতে, এটি সরাসরি সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। মানবাধিকার কমিশনের সহ-সভাপতি ও সাংবাদিক মুনিজা জাহাঙ্গীর বলেন, সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে আর কোনো ভারসাম্য রইল না। যখন সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ কমানোর সময় ছিল, ঠিক তখনই তাদের আরো ক্ষমতা দেওয়া হলো।
আদালতে বড় পরিবর্তন
সংশোধনীর আরো বিতর্কিত অংশ হলো নতুন ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত (এফসিসি) গঠন। সাংবিধানিক প্রশ্নে রায় দেবে এই আদালত। এর প্রধান বিচারপতি ও বিচারকদের নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি।
জাহাঙ্গীর বলেন, এটি ন্যায্য বিচারের অধিকার চিরতরে বদলে দিল। সাংবাদিক ও ভাষ্যকার আরিফা নূর মন্তব্য করেন, এখন বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ হয়ে পড়বে।
সমালোচকদের দাবি—রাষ্ট্র যখন সাংবিধানিক বেঞ্চের গঠন ঠিক করবে, তখন মামলার ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হবে।
আগে সুপ্রিম কোর্টই এসব সাংবিধানিক মামলা শুনতো। সরকার বলছে, আলাদা আদালত গঠনের ফলে সুপ্রিম কোর্টে সাধারণ ফৌজদারি ও দেওয়ানী মামলার জট কমবে।
কিন্তু করাচি-ভিত্তিক আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পাকিস্তানের বেশিরভাগ মামলা সুপ্রিম কোর্টে নয়। তাই এই যুক্তি অযৌক্তিক।
বিচারকদের বদলি ও পদত্যাগ
সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বিচারকদের সম্মতি ছাড়াই তাদের বিভিন্ন আদালতে বদলি করা যাবে। বদলিতে রাজি না হলে বিচারক অবসর নিতে বাধ্য হতে পারেন। সমর্থকদের দাবি, এতে সারা দেশে জনবল ঘাটতি কমবে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এটি বিচারকদের ওপর চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
সংশোধনী পাস হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ ও মনসুর আলী শাহ পদত্যাগ করেন। মিনাল্লাহ বলেছেন, যে সংবিধান রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলাম, সেটি আর নেই। ২৭তম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্টকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, বিচারকদের বিবেক জেগে উঠেছে কারণ সংশোধনী তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়েছে এবং সংসদের কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করেছে।
স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা
বিশ্লেষকদের মতে, এসব পরিবর্তন পাকিস্তানের ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করবে এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে। আরিফা নূর বলেন, এটি কর্তৃত্ববাদের দিকে যাওয়ার পরিষ্কার ইঙ্গিত।
এদিকে নতুন ২৮তম সংশোধনী নিয়েও ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে।
