×

মুক্তচিন্তা

৬২৬ জনের পলায়ন: শক্তিশালী বাহিনী, দুর্বল নৈতিকতা

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪২ এএম

৬২৬ জনের পলায়ন: শক্তিশালী বাহিনী, দুর্বল নৈতিকতা

পলায়ন গ্রাফিক্স: ছবি ভোরের কাগজ

যদি সেনাবাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ৬২৬ জন অভিযুক্ত ব্যক্তি পালিয়ে যায়, তবে এটি সেনা ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভয়াবহ দুর্বলতার প্রমাণ। এটি কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংকটেরও ইঙ্গিত, যেখানে নিয়ন্ত্রণ, আস্থা ও নৈতিকতার ভাঙন স্পষ্ট। প্রশ্ন আসে, এই হেফাজত কাদের হাতে এবং কী উদ্দেশ্যে? এটি কি রাজনৈতিক অভিযানের অংশ, নাকি বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযান?

“ইদানীং যে ২৫ সেনা সদস্যকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের অভিযোগে অভিযুক্ত করে ক্যান্টনমেন্টের হেফাজতে রাখা হয়েছে, তাদের মধ্যে কতজন পালিয়েছে?”—এই প্রশ্নটি কেবল সংখ্যার নয়; এটি বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষা। যদি আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তবে বোঝা যায়—সমস্যা কাঠামোগত, ব্যক্তিনির্ভর নয়।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব সর্বপ্রকাশ্যভাবে সরকারের হলেও সেনা হেফাজতের প্রত্যক্ষ দায় বাহিনীর কমান্ডের। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক নেতৃত্ব—উভয়েই দায়বদ্ধ। যদি তারা গোপন সমঝোতায় যুক্ত থাকে, তবে দায়হীনতার সংস্কৃতি আরও ঘনীভূত হয়।

সেনাবাহিনী কার প্রতি আনুগত্য রাখে—জনগণের প্রতি নাকি ভারতের মতো বিদেশি শক্তির প্রতি, এই প্রশ্ন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার মূলভিত্তিতেই আঘাত করে। সংবিধান অনুযায়ী, সেনাবাহিনী জনগণের মালিকানাধীন হওয়া উচিত; কিন্তু বাস্তবে বাহ্যিক প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ স্বার্থগোষ্ঠী সেটিকে বিকৃত করেছে। সেনাবাহিনীর প্রকৃত আনুগত্য প্রমাণিত হবে অবাধ তথ্যপ্রবাহ, জবাবদিহি ও মানবাধিকার রক্ষার মাধ্যমে—বিদেশি স্বার্থের সেবাদানের মাধ্যমে নয়।

২০২৪ সালের জুলাই–অগাস্টে গণআন্দোলনের পর সেনাবাহিনী বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে মোট ৬২৬ জনকে আশ্রয় দেয়। এই ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন: ২৪ জন রাজনৈতিক নেতা, ৫ জন বিচারক, ১৯ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ৫১৫ জন পুলিশ সদস্য, ১২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা এবং ৫১ জন তাদের পরিবারের সদস্য। এই আশ্রয় মানবিক কারণে দেওয়া হয়েছিল, তবে অধিকাংশই এক বা দুই দিনের মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করেন। পাঁচজনকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।

২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ২৫ জন সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এই সেনা সদস্যরা প্রাক্তন ও বর্তমান কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত। অভিযোগ—শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত গুম, গোপন আটক ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত থাকা।

দুটি ঘটনা পরস্পর সম্পর্কিত হলেও ভিন্ন পর্যায়ের। প্রথমটি মানবিক আশ্রয় প্রদান—যেখানে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় কিছু ব্যক্তিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল; দ্বিতীয়টি আইনি পদক্ষেপ—যেখানে সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উভয় ঘটনাই সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধের প্রশ্ন তোলে।

ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী প্রশাসন এখন বিশ্বাস পুনর্গঠনের কঠিন পরীক্ষায়। প্রশাসন যদি নীরব বা অস্পষ্ট থাকে, জনগণের আস্থা সংকুচিত হবে; কিন্তু সাহসিকতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিলে রাষ্ট্রে নৈতিক নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

সমস্যার মূল—দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আনুগত্যের বিকৃতি। পদোন্নতি ও সুবিধা আজ পেশাগত যোগ্যতার বদলে রাজনৈতিক আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল। সেনাবাহিনীকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলা তার পেশাদারিত্বকে দুর্বল করেছে। “জাতীয় নিরাপত্তা”র অজুহাতে সেনাবাহিনী প্রায়ই আইনি তদারকির বাইরে থাকে—এটাই মূল বিপদ।

করণীয় ব্যবস্থা:

* পদোন্নতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও পেশাগত ভিত্তিতে হতে হবে।

* সংসদীয় প্রতিরক্ষা কমিটি ও নাগরিক পর্যবেক্ষণ কার্যকর করতে হবে।

* সামরিক শিক্ষাক্রমে নৈতিকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

* দুর্নীতির তদন্তে স্বাধীন সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন জরুরি।

* এবং সর্বোপরি, নাগরিকদের সত্য ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য। সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক দায়িত্ব হলো দেশ রক্ষা করা, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিকে রক্ষা করা নয়। “সেফ এক্সিট” প্রয়োগ করা সংবিধানবিরোধী এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার। সেনাবাহিনী যদি ক্ষমতার দালালে পরিণত হয়, রাষ্ট্র নিজেই নিজের পতন ডেকে আনে। দায় ভাগ করে নিতে হবে—

* সেনা নেতৃত্বের দায়: আনুগত্যকে নৈতিকতার উপরে স্থান দেওয়া;

* রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়: সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার যন্ত্রে পরিণত করা;

* রাষ্ট্র কাঠামোর দায়: জবাবদিহির অভাব;

* আর জনগণের দায়: আমরা নীরব থেকেছি।

গত ১২–১৮ মাসে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেওয়া ৬২৬ জনের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় তদন্ত কমিটি এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি মামলার প্রেক্ষিতে সন্দেহভাজন সেনা অফিসারদের গ্রেপ্তার বা হেফাজতের ঘটনাও ঘটেছে।

ন্যায়বিচার, সামরিক শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক জবাবদিহি এখন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এখানে দায় স্বীকার ও স্বচ্ছ তদন্তের দায়িত্ব সব স্তরেই বিদ্যমান।

সেনাবাহিনী জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শতভাগ দায়িত্ব পালন করবে কারণ জনগণের নিরাপত্তাই সেনাবাহিনীর অস্তিত্বের মূল। তবে বর্তমান সেনা নেতৃত্বের আচরণে উদ্বেগজনক কিছু প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যেখানে ক্ষমতার প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও বিদেশি স্বার্থের সঙ্গে সম্ভাব্য সমঝোতার ইঙ্গিত রাষ্ট্র ও সংবিধানের নীতির পরিপন্থী।

রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন শুরু হতে পারে দায় স্বীকারের মধ্য দিয়েই কারণ নৈতিক দায়িত্বই হচ্ছে নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তি। এখন সময় এসেছে নাগরিকদের স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক কর্তব্যের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

খুলনায় নতুন আধুনিক কারাগারের কার্যক্রম শুরু হবে ১ নভেম্বর

খুলনায় নতুন আধুনিক কারাগারের কার্যক্রম শুরু হবে ১ নভেম্বর

সাভারে স্টার টেকের নতুন শাখা উদ্বোধন

সাভারে স্টার টেকের নতুন শাখা উদ্বোধন

বসুন্ধরার এমডি ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ

বসুন্ধরার এমডি ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ

সজল স্মরণে আজিজের সপ্তম একক ম্যারাথন

সজল স্মরণে আজিজের সপ্তম একক ম্যারাথন

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App