×

মুক্তচিন্তা

ওষুধের নামে বিষ: মানবতার বিরুদ্ধে চিকিৎসা‑বাণিজ্যের অদৃশ্য যুদ্ধ

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০২:৪৮ এএম

ওষুধের নামে বিষ: মানবতার বিরুদ্ধে চিকিৎসা‑বাণিজ্যের অদৃশ্য যুদ্ধ

ওষুধের নামে বিষ: মানবতার বিরুদ্ধে চিকিৎসা‑বাণিজ্যের অদৃশ্য যুদ্ধ

চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজ বিশ্বকে অভূতপূর্ব এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মানুষের জীবনকাল বেড়েছে, রোগ নিরাময়ের উপায় উন্নত হয়েছে—কিন্তু এই অগ্রগতির অন্তরালে লুকিয়ে আছে এক নির্মম বাস্তবতা: চিকিৎসা এখন এক লাভজনক ব্যবসা, আর মানুষ সেখানে এক পরীক্ষাগারের বস্তু।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দশ বছরে মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ওষুধের ব্যবহার বিশ্বজুড়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। অথচ আত্মহত্যা, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা ও মানসিক বিভ্রান্তির হারও সমানভাবে বেড়েছে। অর্থাৎ ওষুধ বাড়ছে, কিন্তু সুস্থতা নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য যেখানে ছিল আরোগ্য, সেখানে এখন মুনাফাই হয়ে উঠেছে মূল লক্ষ্য।

বিশ্বব্যাপী ওষুধ কোম্পানিগুলোর এক অঘোষিত সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। তারা চিকিৎসকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে বিভিন্নভাবে—প্রেসক্রিপশন বোনাস, বিদেশ সফর, উপহার, গবেষণার নামে আর্থিক অনুদান ইত্যাদির মাধ্যমে। রোগী নয়, প্রেসক্রিপশনই ব্যবসার চালিকাশক্তি। রোগীরা জানে না, কোন ওষুধ প্রয়োজনীয় আর কোনটি কেবল বিক্রির অংশ। চিকিৎসকরা অনেক সময় বাধ্য হন এমন ওষুধ দিতে যা তারা নিজেরাও পুরোপুরি বিশ্বাস করেন না।

বাংলাদেশের বাস্তবতা আরও গভীর সংকটময়। এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থার ভেতর প্রবেশ করেছে এক “ডাকাতি সিন্ডিকেট”। স্বাস্থ্যখাত এখন এমন এক গোলকধাঁধা, যেখানে রোগীর দুর্বলতা ও অজ্ঞতাকে ব্যবহার করে পকেট ভরছে একদল অসাধু ব্যবসায়ী, ফার্মাসিউটিক্যাল মাফিয়া ও ক্ষমতাবান দালালচক্র।

ঢাকার বাবুবাজারে অবৈধভাবে তৈরি হচ্ছিল গর্ভাবস্থা পরীক্ষার কিট ও কনডম—নকল উপাদানে, সঠিক ফলাফল ছাড়াই। খুলনায় “লাজ ফার্মা” নামের ফার্মেসি বিক্রি করছিল বিদেশি নামে নকল ওষুধ। কেরানীগঞ্জে তৈরি হচ্ছিল ভুয়া হেপাটাইটিস ও টিটেনাস ভ্যাকসিন। ডেমরায় ধরা পড়েছে নকল ক্যান্সার ও COVID‑19 ওষুধের ফ্যাক্টরি।

চট্টগ্রামে ৪৪% ফার্মেসি প্রেসক্রিপশন ছাড়াই নিয়ন্ত্রিত ওষুধ বিক্রি করছে—যেমন বেনজোডায়াজিপাইন, যা দীর্ঘমেয়াদে আসক্তি ও আত্মহত্যার ঝুঁকি তৈরি করে। পিরোজপুর জেলা হাসপাতালে কোটি টাকার ওষুধ ক্রয়ের দুর্নীতি ধরা পড়েছে—হাসপাতালে পৌঁছায়নি ওষুধ, কিন্তু বিল পরিশোধ হয়েছে। Essential Drugs Company Limited-এর বিরুদ্ধেও ৪৭৭ কোটি টাকার দুর্নীতির তদন্ত চলছে, যেখানে টেন্ডারবিধি ও উৎপাদন প্রক্রিয়া লঙ্ঘন হয়েছে। COVID‑19 ভ্যাকসিন ক্রয়ের সময়ও সরকার ও জনসাধারণকে অতিরিক্ত খরচে ফেলেছে এক সিন্ডিকেট।

তথ্যসূত্র মন্তব্য:

এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সরকারি অনুসন্ধান নথিতে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। যেমন—ঢাকার বাবুবাজারে নকল টেস্ট কিট জব্দে ডিবি ও ওষুধ প্রশাসনের অভিযান (২০২৩), কেরানীগঞ্জে ভুয়া হেপাটাইটিস‑বি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কারখানা ধরা পড়া, চট্টগ্রামে প্রেসক্রিপশনবিহীন ওষুধ বিক্রির ওপর জনস্বাস্থ্য গবেষণা (২০১৮), পিরোজপুর জেলা হাসপাতালে ওষুধ ক্রয়‑সংক্রান্ত দুর্নীতি, এবং Essential Drugs Company Limited‑এর ৪৭৭ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম‑সংক্রান্ত ACC তদন্ত (২০২৩–২৪)।

এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এক গভীর রোগের লক্ষণ। চিকিৎসক, কর্মকর্তা, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিনিধি—সবাই মিলে তৈরি করেছে এক দুষ্টচক্র, যার কেন্দ্রে রয়েছে অর্থ ও প্রভাব। ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের বিক্রয় বাড়াতে “বেদনা”কে পণ্য বানিয়েছে। একজন মানুষ মানসিক চাপে পড়লে তাকে পরামর্শ নয়, ওষুধ দেওয়া হচ্ছে—আরেকজন উদ্বিগ্ন হলে তাকে থেরাপি নয়, ট্রাঙ্কুইলাইজার। ফলে সমাজে একদল নির্ভরশীল মানুষ তৈরি হচ্ছে, যারা নিজের মানসিক ব্যথা বোঝে না, কেবল ওষুধে ঢাকা দেয়।

এ যেন এক প্রাতিষ্ঠানিক নেশা—চিকিৎসা পেশাই ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, প্রকৃত আরোগ্য এখন গৌণ। বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, “নতুন জীবন”, “নিদ্রাহীনতায় মুক্তি”, “চিন্তা দূর”—কিন্তু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে, আবার কেউ কেউ জীবন হারাচ্ছে।

স্বাস্থ্যখাতের ভেতর এই মুনাফাকেন্দ্রিক মানসিকতা সমাজে এক গভীর নৈতিক সংকট তৈরি করছে। একজন চিকিৎসক যখন রোগীর পরিবর্তে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হন, তখন চিকিৎসা শুধু পেশা নয়—একটি পণ্য বিক্রির প্রক্রিয়া হয়ে যায়। রোগী তখন আর মানুষ থাকে না, সে হয়ে যায় “টার্গেট”—যার ওপর নির্ভর করে বিক্রয় ও বোনাস।

এই বাস্তবতায় নীরবভাবে মরছে আমাদের বিশ্বাস। মানুষের চোখে চিকিৎসক একসময় ছিলেন অর্ধেক ঈশ্বর, এখন অনেকের চোখে তিনি আরেক ব্যবসায়ী মাত্র। যে ডাক্তার রোগীর ব্যথা শুনতেন, তিনি আজ কোম্পানির বিক্রয় রিপোর্ট শুনতে ব্যস্ত। যে হাসপাতাল আশ্রয় দিত, এখন সেটি বিল পাঠায়।

তবুও, আলো একেবারে নিভে যায়নি। এখনও আছেন কিছু সৎ চিকিৎসক, গবেষক ও সমাজকর্মী—যারা বলছেন, “ওষুধ নয়, মানুষকে সুস্থ করো।” মানসিক স্বাস্থ্য মানে কেবল ট্যাবলেট নয়, দরকার সহানুভূতি, শ্রবণ, ভালোবাসা ও সামাজিক সংহতি। একজন রোগীকে যখন মানুষ হিসেবে দেখা হবে, তখনই চিকিৎসা আবার তার আসল উদ্দেশ্যে ফিরে আসবে।

এই সংকট থেকে বের হতে হলে প্রয়োজন তিনটি জিনিস: নৈতিক পুনর্গঠন, স্বচ্ছতা, এবং জনগণের জবাবদিহি। প্রতিটি ওষুধের অনুমোদন, প্রতিটি চিকিৎসা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত, প্রতিটি সরকারি টেন্ডার—সবকিছুই হতে হবে প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ। চিকিৎসা কোনো কোম্পানির সম্পত্তি নয়, এটি মানুষের অধিকার।

শেষ কথা: সুস্থ সমাজই প্রকৃত রোগপ্রতিরোধক

একটি সমাজের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল ওষুধে তৈরি হয় না—এটি তৈরি হয় ন্যায়, সততা ও খাদ্যনিরাপত্তায়। ভেজালমুক্ত খাদ্য ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের প্রকৃত ভিত্তি। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমাজে নৈতিকতা, আস্থা ও খাদ্যের বিশুদ্ধতা বেশি, সেখানে সংক্রামক রোগের প্রকোপও তুলনামূলকভাবে কম।

বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৪০% খাবার ভেজাল উপাদানে তৈরি হচ্ছে—দুধে ফরমালিন, তেলে সীসা, ফলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড। এই বিষাক্ত উপাদানগুলো কেবল শরীর নয়, প্রজন্মের জিনগত গঠন পর্যন্ত নষ্ট করছে। ফলে যতই ভালো ওষুধ আসুক, রোগের শিকড় রয়ে যাচ্ছে অক্ষত। ভেজাল খাবার যেমন শরীরকে দুর্বল করে, তেমনি দুর্নীতি রাষ্ট্রের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে।

একজন কৃষক যদি সৎভাবে উৎপাদন করতে পারেন, ব্যবসায়ী যদি ন্যায্যমূল্য নেন, আর প্রশাসন যদি সততার সাথে তদারকি করে—তাহলে হাসপাতালের রোগীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসবে। বিশুদ্ধ খাদ্য, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও সুশাসন মিলেই গড়ে তোলে একটি জাতির ‘ইমিউন সিস্টেম’। তাই প্রকৃত চিকিৎসা শুরু হয় খাদ্য থেকে, মন থেকে, এবং নৈতিকতা থেকে।

চিকিৎসা তখনই মানবিক, যখন তা মুনাফার ঊর্ধ্বে থাকে। ওষুধ তখনই জীবন বাঁচায়, যখন তা বিবেকের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। অন্যথায়, এটি হয়ে ওঠে এক বৈজ্ঞানিকভাবে অনুমোদিত বিষ—যা ধীরে ধীরে হত্যা করে আমাদের শরীর নয়, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের মানবতা।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

খুলনায় নতুন আধুনিক কারাগারের কার্যক্রম শুরু হবে ১ নভেম্বর

খুলনায় নতুন আধুনিক কারাগারের কার্যক্রম শুরু হবে ১ নভেম্বর

সাভারে স্টার টেকের নতুন শাখা উদ্বোধন

সাভারে স্টার টেকের নতুন শাখা উদ্বোধন

বসুন্ধরার এমডি ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ

বসুন্ধরার এমডি ও বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ

সজল স্মরণে আজিজের সপ্তম একক ম্যারাথন

সজল স্মরণে আজিজের সপ্তম একক ম্যারাথন

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App