×

মুক্তচিন্তা

কপ৩০ সম্মেলনের ষষ্ঠ দিন

জলবায়ু অর্থায়ন, জনস্বাস্থ্য ও আদিবাসী অধিকারের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

Icon

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০১:৪৫ পিএম

জলবায়ু অর্থায়ন, জনস্বাস্থ্য ও আদিবাসী অধিকারের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। ফাইল ছবি

ব্রাজিলের বেলেমে কপ৩০ জলবায়ু আলোচনার প্রথম দিন আশা জাগানো সূচনার পর অর্থায়ন, কার্বন ট্রেডিং ও প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণের মতো জটিল ইস্যুগুলোর আলোচনা গতি পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক এনার্জি সংস্থা বলছে, কয়লা, তেল ও গ্যাসের শীর্ষ ব্যবহারকে অতিক্রম করে বিশ্ব নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের দিকে এগোচ্ছে, তবে সেটি ধীর গতিসম্পন্ন। মূল বিরোধের জায়গা হল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থায়নের ওপর ধনী দেশ অনুদান কম দিতে চাওয়া, বাজারভিত্তিক মডেল এবং ক্ষতিপূরণ বা সাহায্য না করে ঋণকে প্রাধান্য দেয়া। বিশ্বের ১৩৪টি দেশের জোট জি৭৭ এবং চীন ‘জাস্ট ট্রানজিশন’, ‘গ্রীন টেকনোলজি ট্রান্সফার’ এবং ‘ঋণমূক্ত অর্থায়ন’ এর দাবি তুলেছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতি বছর প্রয়োজনীয় ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে মাত্র ৩’শ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে, যার অধিকাংশই ঋণ। বাস্তবে নগদ অর্থের এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং মাত্র ৩ শতাংশ জাস্ট ট্রানজিশনে ব্যয় হয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক তাপমাত্রার পারদ ঊর্ধ্বগতির দিকে, প্রতিবারের মত এবারও সবাই কপ৩০ উপর আশাবাদী। গত ৫ দিনের পর্যবেক্ষনে মনে হচ্ছে কপ৩০ সম্মেলনর শেষ পর্যন্ত ধনী দেশগুলো ন্যায্য অনুদান নিয়ে দ্বিমুখীতা পোষণ করছে যা বিশ্বকে আরো উত্তপ্ত হওয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১’শ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা সময়মতো পূরণ হয়নি। ওইসিডি’র হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১১৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে লক্ষ্য অর্জন করার কথা। তবে অক্সফামের মতে, ঋণকে অতিমূল্যায়ন করায় প্রকৃত অর্থায়ন অনেক কম অর্থাৎ প্রায় ৯৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার অনুদান ৩৫ বিলিয়ন ডলারের অনুদান-সমতুল্য বা কম। এলডিসি ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যে অর্থ পায়, তার অধিকাংশই সরকারি তহবিল, দ্বিপক্ষীয় সহায়তা ও বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার মাধ্যমে। ২০২২ সালে এই অর্থের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ ঋণ হিসেবে পাঠানো হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ও জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ ৪৪টি দেশে। বাংলাদেশ ও অ্যাঙ্গোলায় এই হার ৯৫ শতাংশের বেশি। বড় অংশ গেছে ভারত, চীন এর মত মধ্যম আয়ের দেশসহ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ধনী পেট্রোস্টেটে। সংযুক্ত আরব আমিরাত জাপান থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি জলবায়ু ঋণ পেয়েছে; সৌদি আরব পেয়েছে প্রায় ৩২৮ মিলিয়ন ডলার; চীন প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার এবং ভারত প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার তহবিল পেয়েছে। ইউরোপেও সার্বিয়া ও রোমানিয়ার মতো দেশগুলো উল্লেখযোগ্য অর্থ পেয়েছে।

কার্বন ব্রিফ, জাতিসংঘ ও ওইসিডি’র তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে, ধনী দূষণকারী দেশগুলোর কাছ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশে তহবিল যাওয়ার একটি কার্যকর ব্যবস্থা থাকলেও, এর বড় অংশই কোনো কেন্দ্রীয় তদারকি ছাড়াই পৃথক দেশের রাজনৈতিক বিবেচনায় বিতরণ হচ্ছে। ফলে তহবিল সবসময় সবচেয়ে দরকারি স্থানে পৌঁছায় না। জাপান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স সরকারি জলবায়ু অর্থায়নের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রদান করে থাকে। বাইডেনের সময়ে মার্কিন অর্থায়ন বাড়লেও ট্রাম্পের সময়ে ইউএসএআইডি বন্ধ করা ও অর্থ কমানোর হুমকি ভবিষ্যৎ অনুদানকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। পাশাপাশি অন্য কয়েকটি ধনী দাতাও তাদের সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে।  

কপ৩০ এ প্রথমবার বৈশ্বিক জীবাশ্ম জ্বালানি হ্রাস ও নবায়নযোগ্য শক্তিতে রূপান্তরের রূপরেখা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলার উপস্থাপিত রোডম্যাপকে বিভিন্ন দেশ “গেম চেঞ্জার” হিসেবে অভিহিত করে সমর্থন দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো সহজলভ্য অর্থায়নের দাবি তুলছে। কিন্তু আফ্রিকা উন্নয়ন ব্যাহত না করার ওপর জোর দিচ্ছে। নবায়নযোগ্য শক্তির বিস্তারে খনিজ উত্তোলন ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা পোষণ করছে, বিশেষত আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উপর এর প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ খনিজ উৎপাদক না হলেও, বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধিতে সৌর, বায়ু ও ব্যাটারি প্রকল্পের খরচ ও সরবরাহে প্রভাব পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনের এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও মানবাধিকার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

ইতোমধ্যে দক্ষিণ আমেরিকায় পীত জ্বর ও ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার দেখাচ্ছে যে, নিঃসন্দেহে এটি জলবায়ু সংকট যা এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলছে। এই বছর অঞ্চলটিতে পীত জ্বরের ৩৫৬ জন রোগী ও ১৫২ জনের মৃত্যু রেকর্ড হয়েছে, যা ১৯৬০ সালের পর সর্বোচ্চ। একই সঙ্গে ব্রাজিলে ২০২৪ সালে প্রায় ৬৫ লাখ ডেঙ্গু রোগী ও ৫ হাজার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ইউরোপেও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এডিস মশার দ্রুত বিস্তার ঘটাচ্ছে, ফলে উষ্ণমণ্ডলীয় রোগ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন মানব-সংক্রামক রোগকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে। তীব্র তাপ, বন্যা, খরা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এর কারণে রোগ বালাই বৃদ্ধি, অপুষ্টি ও মৃত্যুহার বাড়াচ্ছে এবং স্বাস্থ্যখাতে বিপুল চাপ সৃষ্টি করছে। ব্রাজিল এবং ডাব্লিউএইচও সমন্বিত নতুন বেলেম স্বাস্থ্য কর্মপরিকল্পনা দেশগুলোকে জলবায়ু-প্ররোচিত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা করবে। ৩৫টি সংগঠন এই উদ্যোগে ৩’শ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বিশ্বে প্রতি মিনিটে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে, যা প্রমাণ করে সরকারগুলো এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের মানবিক ক্ষতি রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ। শুক্রবার সকালে কপ৩০-এর প্রধান প্রবেশপথ কয়েক ঘণ্টা অবরোধ করে ব্রাজিলের মুন্ডুরুকু আদিবাসীরা রাষ্ট্রপতি লুলার সঙ্গে সরাসরি আলোচনার দাবি জানায়। দাঙ্গা পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর বাধার মুখে তারা শেষ পর্যন্ত কপ সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগোর সঙ্গে কথা বলেন। অবরোধের কারণে দীর্ঘ সারি তৈরি হলে প্রতিনিধিদের বিকল্প পথ দিয়ে প্রবেশ করানো হয়। এই বিক্ষোভ কপ৩০-এ নাগরিক সমাজ ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির প্রতিফলন।

জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস বলেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের প্রভাব মোকাবেলায় আদিবাসী ও জনগণের সংগঠনের শক্তিশালী কণ্ঠ দরকার। এ বছরের সম্মেলনে প্রতি ২৫ জনে একজন জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্ট উপস্থিত হয়েছেন। সম্মেলনের ভেতর-বাইরে কৃষি ব্যবসা, খনন, পরিবহন, নারী অধিকার, ফিলিস্তিন, এবং আদিবাসী ভূমি সীমানা নির্ধারণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিদিন বহু প্রতিবাদ, নৌবহর মিছিল ও কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নাগরিক সমাজের প্রধান দাবি হলো বেলেম অ্যাকশন মেকানিজম (বিএএম) গঠন, যা জাস্ট ট্রানজিশনকে সমর্থন করবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে শ্রমিক ও সম্প্রদায়কে কেন্দ্রীয় ভূমিকা দেবে। কায়াপো নেতা রাওনি মেটুকটিরে সতর্ক করে বলেন, আমাজনের ধ্বংস অব্যাহত থাকলে বিশ্ব ভয়ংকর পরিণতির মুখে পড়বে। কপ৩০-এ তাদের এই উপস্থিতি তাই পরিবেশ রক্ষা ও আদিবাসী অধিকারের বৈশ্বিক দাবি আরো জোরদার করছে। 

ব্রাজিলিয়ান আমাজনের আদিবাসী সংগঠন কোইয়াবের নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৩-২০২৫ সালে আমাজন অঞ্চল সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে তীব্র খরা ও দাবানলের মুখোমুখি হয়েছে। জরিপে দেখা যায়, চরম খরার প্রভাবে থাকা এলাকার পরিমাণ ২০২৪ সালের জুনে ৮ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বেড়ে ২ কোটি ১০ লাখ হেক্টরে পৌঁছেছে অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে ২ হাজার ৩’শ শতাংশ বেড়েছে। এতে ১৬০টিরও বেশি আদিবাসী অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এল নিনো, উত্তর আটলান্টিকের উষ্ণতা বৃদ্ধি, বন উজাড় ও বনভূমির অবক্ষয়সহ বিভিন্ন কারণ একত্রে এই সংকটকে তীব্র করেছে। কোইয়াবের মতে, আদিবাসীদের সুরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো তাদের ভূমির সীমানা নির্ধারণ ও আইনগত স্বীকৃতি দেওয়া। বর্তমানে আমাজনে ২৯টি আদিবাসী অঞ্চল সীমানা নির্ধারণের অপেক্ষায় রয়েছে, যা পূরণ করলে সরকার আদিবাসীদের প্রতি প্রকৃত প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করতে পারবে।

কপ৩০-এ বেলেমে অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্কের প্যাভিলিয়ন পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে। উভয় দেশ ২০২৬ সালে কপ৩১ আয়োজনের প্রতিযোগিতায় আছে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। অস্ট্রেলিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আয়োজনের পক্ষে হলেও তুরস্ক উত্তর-দক্ষিণ সংযোগে ভূমিকা রাখতে চায়। কপ৩১-এর হোস্ট ঠিক করা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে জটিল। এক্ষেত্রে ডবড়ম দেশগুলোর অর্থাৎ জাতিসংঘ কর্তৃক কপ৩১-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত পশ্চিম ইউরোপ এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর ২৮ জন সদস্যের ঐক্যমত্য প্রয়োজন। ব্রাজিল ও ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল এই পরিস্থিতির মধ্যস্থতা করছে। আলোচকরা আশা করছেন শীঘ্রই কপ৩১ আয়োজনের স্থানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিশ্চিত হবে। 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইসি: সিইসি

নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইসি: সিইসি

মাগুরা-২ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সড়ক অবরোধ

মাগুরা-২ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সড়ক অবরোধ

অভিনেত্রী মেহজাবীনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

অভিনেত্রী মেহজাবীনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

আসিফের মন্তব্যে বাফুফের কাছে বিসিবি সভাপতির দুঃখ প্রকাশ

আসিফের মন্তব্যে বাফুফের কাছে বিসিবি সভাপতির দুঃখ প্রকাশ

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App