×

মুক্তচিন্তা

অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাও অন্যায়

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৫৫ এএম

অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাও অন্যায়

অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাও অন্যায়

২৪শের গণঅভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচারী শাসনের অবসান এবং একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা। সেই লক্ষ্যেই পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ঘোষণাটি ছিল স্পষ্ট, বাংলাদেশে আর দাসত্ব থাকবে না, থাকবে না বৈষম্য। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, শাসকের নাম বদলেছে, শাসনের চরিত্র বদলায়নি। শেখ হাসিনা ও তার শাসনের পতন ঘটেছে, কিন্তু ক্ষমতার কাঠামো, সুবিধাভোগের সংস্কৃতি এবং ভিআইপি মানসিকতা আগের মতোই রয়ে গেছে।

গণঅভ্যুত্থানের পর হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিশাহারা জাতি আশার আলো দেখেছিল ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে। আমিও বিশ্বাস করেছিলাম, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এমন একজন ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের দুর্দিনে এসে একটি নতুন দিশা দেখাতে পারবেন। কিন্তু তার যাত্রার শুরুতেই যে দুটি গুরুতর ভুল দেখা গেল, তা ছিল অনেকটাই অঙ্কুরেই সম্ভাবনার বিনাশ। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় সংকটের আগে তিনি নিজের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো সমাধানে অগ্রাধিকার দিলেন। দ্বিতীয়ত, একটি দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাঠামোর মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনা শুরু করলেন, যার ফলাফল হিসেবে দীর্ঘ ষোলটি মাস জাতির জন্য আরও অনিশ্চয়তা ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আইন বিভাগের জটিলতা এবং সশস্ত্র বাহিনীর কার্যকর ভূমিকার সীমাবদ্ধতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে, এ বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য, দৃঢ় নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকলে এই বাধাগুলো অনেকাংশেই মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল।

বিশেষ পরিস্থিতিতে সীমিত ভিআইপি প্রটোকল থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ব্যবধান এত বিশাল কেন এবং কেন তা এখনো নির্বিঘ্নে চলমান। এই বৈষম্যের দায় কি শুধু সরকার বা প্রশাসনের। না। এর দায় বাঙালি জাতির নিজেরও। দীর্ঘদিন ধরে তোষামোদ, চাটুকারিতা এবং ক্ষমতার কাছে নতজানু হওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করেছে ঠিক যেমনভাবে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

এই বাস্তবতার দুটি স্পষ্ট উদাহরণ তুলে ধরা যাক। দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও রাজনৈতিক টানাপড়েনের পর তারেক রহমান বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসতে পেরেছেন। এই প্রত্যাবর্তন কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অবদান নয়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ এবং আত্মত্যাগই এই রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্ভব করেছে। কিন্তু সেই প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে যে আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা দেখা গেল, তা বৈষম্যের নগ্ন চিত্র তুলে ধরেছে। তারেক রহমানের আগমনে সড়ক যোগাযোগ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। বিমানবন্দর থেকে সাধারণ যাত্রীরা, যাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী কর্মী ছিলেন, পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেন। এরা সেই মানুষ, যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে, বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে ধরে রেখেছে। অথচ তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত। অন্যদিকে যাদের দেশের জন্য বাস্তব অবদান প্রশ্নবিদ্ধ, তারাই রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ও প্রটোকলের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী হয়ে ওঠে।

দ্বিতীয় উদাহরণ আরও গভীর ও উদ্বেগজনক। প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মীরা রাষ্ট্রীয় বেতন, ভাতা, সুযোগ সুবিধা এবং নিরাপত্তা ভোগ করার পরও ধারাবাহিকভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তারাই অব্যাহতভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের একটি সম্পূর্ণ কাঠামো গড়ে উঠেছে, যার প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। তারপরও এই গোষ্ঠীই ভিআইপি প্রটোকলের আশ্রয়ে থাকে, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ভোগ করে এবং জনগণের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখে।

অন্যদিকে সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষার সারিতে। কেউ দাঁড়িয়ে থাকে একটি চাকরির আশায়, কেউ ন্যায্য সেবার আশায়, কেউবা কেবল সামান্য মর্যাদার প্রত্যাশায়। কিন্তু অধিকাংশ সময় তারা পায় শুধু নিপীড়ন, নির্যাতন এবং অবহেলা। জনগণ আজও সেই বংশীবাদক হ্যামিল্টনের পেছনে সারি বেঁধে হাঁটে, কিছু একটা পাওয়ার আশায়। শেষ পর্যন্ত যা পায়, তা কখনোই ন্যায্য অধিকার নয়।

এই বাস্তবতায় একটি সত্য অনিবার্যভাবে সামনে আসে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোও অন্যায়। যে জাতি অন্যায় দেখে নীরব থাকে, যে সমাজ বৈষম্যকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, সে সমাজ কখনো প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারে না। ২৪শের গণঅভ্যুত্থান যদি কেবল শাসক পরিবর্তনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ইতিহাসের কাছে তা একটি ব্যর্থ সম্ভাবনা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। পরিবর্তন আসবে তখনই, যখন ক্ষমতার প্রটোকলের চেয়ে মানুষের মর্যাদা বড় হয়ে উঠবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক দায়বদ্ধতা।

এই প্রেক্ষাপটে এসে আমাদের একটি অপ্রিয় কিন্তু অনিবার্য সত্যের মুখোমুখি হতে হয়।

লন্ডনে দীর্ঘ সতেরো বছরের নির্বাসন শেষে কোনো রাজনৈতিক নেতার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন এবং তাঁকে স্বাগত জানাতে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম নিঃসন্দেহে একটি বড় রাজনৈতিক ঘটনা। এটি মানুষের ক্ষোভ, বঞ্চনা এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই আবেগঘন দৃশ্যের আড়ালে কিছু কঠিন বাস্তব সত্য উপেক্ষা করলে জাতি আবারও আত্মপ্রতারণার চক্রে আবদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

এই নেতার রাজনৈতিক অতীত কোনোভাবেই বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। তাঁর শাসনকাল ও রাজনৈতিক জীবনে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয়করণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার অভিযোগ দেশ ও দেশের বাইরে বহুবার উঠে এসেছে। এগুলো কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভাষ্য নয়। বিভিন্ন তদন্ত, প্রতিবেদন এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণেও এসব বিষয় নথিভুক্ত হয়েছে। নির্বাসনজীবনকে নিঃশর্ত ত্যাগ বা আদর্শিক সংগ্রামের ফল হিসেবে দেখার সরল ব্যাখ্যাও বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই প্রত্যাবর্তনের কেন্দ্রবিন্দুতে আজও যারা দৃশ্যমান, তাঁদের অনেকেই অতীতের পরিচিত মুখ। তাঁরা পরীক্ষিতভাবে ব্যর্থ, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং প্রশাসনিকভাবে অদক্ষ। এই মানুষরাই এক সময় ক্ষমতায় থেকে জনগণের আস্থা ভেঙেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বল করেছে এবং রাজনীতিকে সেবার পরিবর্তে ব্যক্তিগত লাভের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন যদি এই পুরনো ও কলুষিত কাঠামোর ওপর দাঁড় করানো হয়, তবে সেই স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ নেবে না।

এই বাস্তবতায় লক্ষ লক্ষ মানুষের আবেগী উপস্থিতি একদিকে যেমন দীর্ঘদিনের বঞ্চনার প্রকাশ, অন্যদিকে তা গভীর উদ্বেগের কারণও। আবেগ যখন স্মৃতিকে আড়াল করে, তখন মানুষ অতীতের ব্যর্থতা ভুলে যায়। নেতা প্রশ্নাতীত হয়ে ওঠে এবং জনতা পরিণত হয় অন্ধ অনুসারীতে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, এখান থেকেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি শুরু হয়।

সংখ্যার জোর কোনো নেতাকে স্বচ্ছ, নৈতিক বা দক্ষ করে তোলে না। গণতন্ত্রের প্রকৃত মাপকাঠি হলো জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার সদিচ্ছা এবং নতুন সৎ দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলার সক্ষমতা। কেউ যদি সত্যিই পরিবর্তনের প্রতীক হতে চান, তবে তাঁকে নিজের অতীতের দায় স্বীকার করতে হবে। তাঁকে স্পষ্টভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য পুরনো নেতৃত্ব থেকে নিজেকে আলাদা করতে হবে এবং আবেগের রাজনীতি নয়, নীতির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এই মুহূর্তটি তাই শুধু উৎসবের নয়, গভীর আত্মসমালোচনারও। জনগণের দায়িত্ব উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি প্রশ্ন তোলা। এই নেতৃত্ব কি সত্যিই নতুন, নাকি পুরনো ব্যর্থতার নতুন রূপ। এই প্রত্যাবর্তন কি গণতন্ত্রের পথে অগ্রগতি, নাকি আবেগে ভর করে আবারও একই চক্রে ফিরে যাওয়া।

আবেগ মানুষকে জাগাতে পারে, কিন্তু দেশ গড়ে না। দেশ গড়ে স্মৃতি, বিবেক, যুক্তি এবং নৈতিক সাহস। এগুলো উপেক্ষা করলে আজকের জনসমুদ্রই কালকের হতাশার মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন, [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাও অন্যায়

অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাও অন্যায়

সত্য ঘটনা অবলম্বনে রাহিতুলের নতুন উপন্যাস ‘দুই ভুবনের মানুষ’

কী সত্য লুকিয়ে ছিল সেই ক্যাসেটে সত্য ঘটনা অবলম্বনে রাহিতুলের নতুন উপন্যাস ‘দুই ভুবনের মানুষ’

পিলখানায় শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের কবর জিয়ারত করলেন তারেক রহমান

পিলখানায় শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের কবর জিয়ারত করলেন তারেক রহমান

ধানের শীষে ভোট করতে দল ছাড়লেন যারা

ধানের শীষে ভোট করতে দল ছাড়লেন যারা

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App