জুলাই সনদ
রাজনৈতিক ঐকমত্যে ফাটল

হরলাল রায় সাগর
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৪১ এএম

ছবি : সংগৃহীত
রাষ্ট্র সংস্কারে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে পরিচিত এই সনদ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আট মাস সংলাপের ফসল। মত-পথের ভিন্নতা থাকলেও ডান, বাম ও ধর্মভিত্তিকসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই জুলাই সনদ প্রণয়নে ঐকমত্যে পৌঁছায়। যদিও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিতর্কের এখনো সুরাহা হয়নি। বন্ধ হয়নি এই মতভিন্নতা নিয়ে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের মধ্যে চলে আসা কথা চালাচালিও।
বরং জুলাই সনদ স্বাক্ষর ঘিরে ঐক্যের ফাটল আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক আদর্শের মিল না থাকলেও এনসিপি ও সিপিবিসহ চারটি বাম দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। তাদের সনদে স্বাক্ষর না করার কারণও আলাদা। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের এই অবস্থান নিয়ে আলোড়ন তুলেছে। চলছে বিশ্লেষণ। এরইমধ্যে আক্রমণাত্মক বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও একাধিক বার রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোগ করা জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুই পর্বে আলোচনা করে জুলাই সনদ তৈরি করেছে। প্রথম পর্বে ৩৩টি ও দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫২টি। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে এই আলোচনায় রাখা হয়নি। সংলাপে থাকা ৩০টি দল ও জোটের মধ্যে ২৫টি জুলাই জাতীয় সনদে সই করে ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে।
১৭টি বিষয়ে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। বাকি ৬৭টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে; নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিয়েছে। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫। তবে এই জুলাই সনদে ভিন্নমত যথাযথভাবে উপস্থাপন না করা এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে অধিকাংশ দলের মধেই মতবিরোধ রয়েছে। এছাড়া জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি দিতে গণভোট এবং গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে দলগুলোর মধ্যে।
জুলাই সনদের কোনো আইনি ভিত্তি না দেয়া, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া প্রকাশ না করা এবং সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা জাতির সঙ্গে উম্মোচন না করায় জুলাই সনদে স্বাক্ষর থেকে বিরত থেকেছে জুলাই সনদ তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখা ছাত্রদের সংগঠন এনসিপি। তাদের সঙ্গে কোনোভাবে আদর্শিক মিল না থাকলেও একইভাবে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করেনি চারটি বাম দল- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) এবং বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ।
তাদের দাবি, জুলাই সনদে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, রাজনৈতিক দলের ইতিহাস তুলে না ধরা, সংবিধানের মূল নীতির পরিবর্তন এবং এ বিষয়ে তাদের ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট উপস্থাপন হয়নি। এছাড়া বিএনপি ও তাদের সমমনা দল এবং জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা ৭টি দল জুলাই সনদে সই করলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, গণভোট, নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি এবং ক্ষমতার কৌশলগত লড়াইয়ে চরম মতবিরোধ রয়েছে।
গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দীর্ঘ দিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে চরম দূরত্ব তৈরি হয়। এখন তাদের স্ব স্ব অবস্থানই জানান দিচ্ছে রাজনৈতিক অনৈক্য কতটা স্পষ্ট। রাজনীতিতে যে ঐক্যের সংকট রয়েছে তা কেবল রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্যেই নয়, খোদ সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও বারবার বক্তব্যেও ফুঠে উঠেছে। সর্বশেষ জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানেও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচনটা উৎসবমুখর করে করতে হবে। এজন্য জুলাই সনদের ঐক্যের সুরেই নির্বাচনের দিকে যাবো। রাজনীতির ব্যাপারেও ঐকমত্য, নির্বাচনের ব্যাপারেও ঐকমত্য। আপনারা রাজনৈতিক নেতারা বসে, বিভিন্ন দলের নেতারা বসে সহজ করেন, কীভাবে নির্বাচন করবেন।একইভাবে রাজনৈতিক দলগুলোতে ঐক্যের কথা বলেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, রাজনীতিতে মতপার্থক্য না থাকলে তা গণতান্ত্রিক হয় না। মত ও পথের পার্থক্য থাকবে, কিন্তু এক জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এবং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যয়ের মন্তব্যে স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে রাজনীতি মতৈক্য রয়েছে চরম পর্যায়ে।
বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে শুক্রবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় এনসিপি প্রায় সব ব্যাপারে পজিটিভ ছিল। যে ব্যাপারটায় সমস্যা আছে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে পরেও কথা বলতে পারতাম। সনদে সই না করাটা, তাদের এটা বিচক্ষণতার অভাব।
শনিবার বিএনপির নীতি-নির্ধারণী ফোরামের নেতা সালাহউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ‘কিছু দলের জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করা নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলবে না। আমরা মনে করি, সহনশীলতা সবার মধ্যে আসবে। হয়তো তাদের কিছু দাবি-দাওয়া আছে। এক পর্যায়ে তারাও জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আর গণতন্ত্রের মধ্যে সবাই একমত হবে, এমন তো নয়। সেটা উন্মুক্ত আছে। ভিন্ন মত থাকতেই পারে।’
একই সঙ্গে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান ঘিরে সংঘর্ষের ঘটানাকে ‘জুলাই যোদ্ধা নামে বিশৃঙ্খলা করেছে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট বাহিনী’ এমন মন্তব্যও করেছিন এই বিএনপি নেতা। দাবি পূরণে বিক্ষোভে নামা ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ নিয়ে বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
বিএনপি নেতার বক্তব্যকে গুরুতর অসৌজন্যতা বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। শনিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে তিনি বলেছেন, জুলাই যোদ্ধাদের স্বৈরাচারের দোসর বলাটা গুরুতর অসৌজন্যতা হিসেবেই বিবেচিত হবে। দয়া করে দায়িত্বশীল কোনো জায়গা থেকে আমরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করা জাতির গর্বিত লোকগুলোর ব্যাপারে এমন কথা বলবো না। কেউ এমন আচরণ করলে জাতি তাদের ক্ষমা করবে না। সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারা আমরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবো, ইনশাআল্লাহ।
জুলাই সনদের বিষয়ে অবস্থান তুলে ধরতে এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, তাদের পর্যবেক্ষণ, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে জাতিকে ধোঁয়াশায় রাখা হয়েছে। জুলাই সনদে সই কেবল আনুষ্ঠানিকতা। যদি এর আইনি ভিত্তি তৈরি না হয় এটার কেবল আনুষ্ঠানিকতাও থাকবে না, এটি একটি গণপ্রতারণা এবং জাতির সঙ্গে একটি প্রহসন হবে। তিনি বলেন, যেই দলগুলো জুলাই সনদে সই করেছে তাদের ভিন্ন দাবি আছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই এবং দাবিরও মিল নেই। যারা সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে গিয়েছিল, যেই প্রক্রিয়ায় সই দিয়েছে, অভ্যুত্থান এবং জনগণ থেকে তারা ছিটকে গেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্যের ন্যায্যতার চেয়ে ‘পেশিশক্তি’ এবং সরকারের ভেতরে নানা ধরনের ‘প্রভাব বিস্তার’ বেশি কাজ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন নাহিদ ইসলাম।
জুলাই সনদের আইনি বৈধতাসহ কয়েকটি দাবিতে আন্দোলনরত জুলাই যোদ্ধাদের ওপর হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। একইসঙ্গে যারা জুলাই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারতাদের বাদ দিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে সনদে স্বাক্ষর করা জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার সঙ্গে চরম প্রতারণা বলে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি রিফাত রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান ইনাম।