×

তথ্যপ্রযুক্তি

সাইবার সহিংসতা

সহিংসতার শিকার ৮ শতাংশ নারী

Icon

সেবিকা দেবনাথ

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম

সহিংসতার শিকার ৮ শতাংশ নারী

ছবি : সংগৃহীত

নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে যেন নিত্যই নতুন ধরন ও মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। তেমনই এক ধরন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সহিংসতা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নারীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও, একই সঙ্গে এটি একটি বিপজ্জনক স্থানে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ফেইসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রামসহ অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারী হয়রানি, ব্ল্যাকমেইল, ব্যক্তিগত ছবি অপব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের ঘটনা বাড়ছে। কমেন্ট বক্সের মন্তব্য প্রায়সময়ই সাইবার বুলিংয়ের রূপ নেয়। এই ডিজিটাল সহিংসতা কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়, বরং সামাজিক ও মানসিক নিরাপত্তার জন্য গভীর হুমকি।

সাইবার অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (২০২২) অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জন নারী অনলাইন ব্যবহারকারীর মধ্যে ৭ জন সাইবার বুলিংয়ের শিকার হন। অধিকাংশই অভিযোগ করতে ভয় পান, কারণ পরিবার নিরুৎসাহিত করে বা তারা নিজেরাই বিশ্বাস করেন- অভিযোগ করে কিছুই হবে না। ইউএনডিপির এক জরিপে দেখা গেছে, ধর্ম, যৌনতা বা শরীর নিয়ে কথা বললে নারীদের ‘নোংরা’ বা ‘পশ্চিমা’ হিসেবে ট্যাগ দেয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিপীড়নের শিকার নারীদের মাত্র ২০ শতাংশ আইনি সহায়তা নেন; বাকিরা নীরব থাকেন। এ চিত্র শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সংকট নয়, বরং আমাদের আইনি কাঠামোর ব্যর্থতাকেও প্রকাশ করে। দেশের বিচারব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে সাইবার সহিংসতার মামলা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যবেক্ষণহীন অবস্থায় খারিজ হয়ে যায়- এ এক বিপজ্জনক নিস্পৃহতা। আইসিটি আইন বা পেনাল কোড থাকলেও, ডিপফেইক বা ডিজিটাল স্টকিংয়ের মতো অপরাধ মোকাবেলায় এগুলো অপ্রতুল।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৫০ শতাংশ নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার, যাদের ৭৬ শতাংশ মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগে ভোগেন। অনেক নারী ভয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছেড়ে দেন বা পরিচয় গোপন করেন, যা তাদের মত প্রকাশের অধিকার সীমিত করে।

চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনলাইন সহিংসতার শিকার নারীর সংখ্যা ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। যার মধ্যে ব্ল্যাকমেইল ১৭ শতাংশ, ছবি অপব্যবহার ৪১ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ ১৮ শতাংশ, অ্যাকাউন্ট হ্যাক ৯ শতাংশ, সাইবারবুলিং ৮ শতাংশ। বিশেষত ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরী নারীরা সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ। ৫০ শতাংশ নারী নিরাপত্তার কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের পরিচয় গোপন রাখছেন, বা ব্যবহার সীমিত করেছেন।

২০২১-২২ সালে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুকের তত্ত¡াবধানে একটি গবেষণা হয়, যা ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়। গবেষণাটি করেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোকসানা সিদ্দীকা। ‘সাইবার সহিংসতার শিকার নারীদের মনোসামাজিক পরিবর্তন এবং বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল্যায়ন’ শিরোনামের ওই পিএইচডি গবেষণায় বলা হয়েছে, সাবেক প্রেমিকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সাইবার সহিংসতার শিকার হয়েছেন মেয়েরা। এ হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। অনলাইন বন্ধুর মাধ্যমে ২০ শতাংশ, অপরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে ১৬ শতাংশ, সাবেক স্বামীর মাধ্যমে ১২ শতাংশ, বন্ধুর মাধ্যমে ৮ শতাংশ, সহকর্মী ও সহপাঠীর মাধ্যমে ৬ শতাংশ এবং স্বজনদের মাধ্যমে ৪ শতাংশ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীদের প্রায় ৯০ শতাংশই শহরের বাসিন্দা। ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী, প্রায় ২৯ শতাংশ সরকারি ও ২০ শতাংশ বেসরকারি চাকরিজীবী এবং ১২ শতাংশ গৃহিণী।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সাইবার ওয়ার্ল্ড একটা ইনফিনিটি ওয়ার্ল্ড। এটা গ্লোবাল। সাইবার জগতে মেয়েদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। আইন হচ্ছে, কিন্তু এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নারীর দৈনন্দিন জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে- এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের উচিত, এখন নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে মনোযোগ দেয়া।

কয়েক মাস আগে নারী ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ সাইবার বুলিং প্রতিরোধে নারীদের জন্য একটি ইউনিট গঠনের কথা বলেছিলেন। এটি ইঙ্গিত দেয়, নারীদের ডিজিটাল স্পেস এখনো নিরাপদ নয়। এদিকে গতকাল সোমবার সচিবালয়ে তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ বলেন, নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ঘরোয়া পরিবেশ, কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সবখানেই নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন সার্ভে-২০২৪’-এর তথ্য অনুযায়ী, শারীরিক, মানসিক, যৌন ও অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাইবার স্পেসে অধিকাংশ নারী ভিকটিম হয় প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতার অভাবে এবং অপরাধ প্রমাণের জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ না থাকার কারণে অপরাধী মুক্তি পেয়ে যায়। বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহারের আগে পরিষ্কার ধারণা নিতে হবে। নারী ও কন্যার প্রতি সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে একাধিক সিমকার্ড ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমূহকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং টিকটক, ইমো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনি নীতিমালা তৈরির ওপর জোর দেন।

আইনজীবীরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে যেসংখ্যক পুলিশি থানা রয়েছে, সেখানে মামলা তদন্ত কর্মকর্তাদের সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এতে ঢাকা সিটির চাইতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের সাইবার সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধে সাইবার সাপোর্ট টিমের জনবল, সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে। 

সাইবার সহিংসতা ও পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ এবং ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২’ আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা আলী। ভুক্তভোগীদের বিচারের প্রতি আস্থা বাড়ানোর জন্য থানাগুলোকে আধুনিক করার পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা বাড়ানো, ভুক্তভোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করার ওপর জোর দেন তিনি।

এই প্রেক্ষাপটে আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ। ১৬ দিনব্যাপী পক্ষ শেষ হবে ১০ ডিসেম্বর। এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘ইউনিট টু অ্যান্ড ডিজিটাল ভায়োলেন্স অল উইমেন অ্যান্ড গার্লস’ (বাংলা প্রতিপাদ্য- ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হই, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করি)। এ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আজ সকাল ৯টায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ১৬ দিনের কর্মসূচির উদ্বোধন হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘ সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, নারী ও যুব সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।

এছাড়া ১৬ দিনের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা, র‌্যালি, আলোচনা সভা ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ প্রচার জোরদার, কুইক রেসপন্স টিম (০১৭১৩৬৫৯৫৭৩, ০১৭১৩৬৫৯৫৭৪) সম্পর্কিত প্রচার, স্থানীয় পর্যায়ে উঠান বৈঠক ও কমিউনিটি সচেতনতা কার্যক্রম, আইনি সহায়তা ও মনোসামাজিক কাউন্সেলিং, সাইবার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সচেতনতা কর্মসূচি, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল সহিংসতা প্রতিরোধে একযোগে শপথ পাঠসহ নানা ধরনের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

মানবতাবিরোধী অপরাধে মাহবুব উল আলম হানিফের বিচার শুরু

মানবতাবিরোধী অপরাধে মাহবুব উল আলম হানিফের বিচার শুরু

পর্যবেক্ষকদের নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের আহ্বান সিইসির

পর্যবেক্ষকদের নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের আহ্বান সিইসির

চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা নিয়ে হাইকোর্টের রায় যেদিন

চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা নিয়ে হাইকোর্টের রায় যেদিন

অনির্বাচিত সরকারের বন্দর বা এলডিসি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই

তারেক রহমান অনির্বাচিত সরকারের বন্দর বা এলডিসি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App